বাংলা ভাষাকে তার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত
করেছেন বাংলার মানুষ ১৯৫২ সালে জীবন দিয়ে। তারপর আজ অবধি আমাদের ভাষা আমাদেরই আছে, বাংলা বাংলার কাছেই
আছে। তবে এতটা নিশ্চিত মনে কথাটা বলা যাচ্ছে না-বলতে পারলে স্বস্তি হত, ভারমুক্ত লাগত। বরং
ক্রমাগত দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হচ্ছি চারপাশে বাংলা ভাষার দিকে নানারকমভাবে আক্রমণ হতে
দেখে। বলা যায় ভাষার উপর নির্যাতন চলছে, কখনও সরাসরি, কখনও তার সাহিত্য
প্রকাশের মাধ্যম তথা আবৃত্তি,
নাটক, গান, কবিতার ভিতর দিয়ে। এই আঘাত একেবারে
না বুঝে করছে এমনটা বলা আহম্মকী হবে।
বলা আবশ্যক সব ভাষারই চলবার কতক নিয়ম
থাকে। ক্রমাগত পরিবর্তন হওয়া,
পরিমার্জন হওয়া ইত্যাদির। সেই
পরিবর্তনকেও বুঝতে হবে, তার কথাও মনে রাখতে হবে। তাকে মনে রেখেই উপযুক্ত দুরবস্থা নিয়ে
আলোচনা করা যায়।
দুটি প্রধানভাগে ভাষা আজ আক্রমণের
শিকার। প্রথম ভাগটির কাজ শুরু হয় শিশুমনকে পর্যদুস্তের মধ্য দিয়ে। প্রযুক্তির
কল্যাণে আমরা এখন অনেক নতুনকে কানে শুনি, চোখে দেখি। অত্যন্ত স্বাভাবিক কিংবা
অপরিহার্য ভেবে। ভিসিডির কল্যাণে এখন শুনা এবং দেখা দুটোই একই সঙ্গে হয়। আরও কাছে
চলে আসে যা কিছু দেখতে চাই, শুনতে চাই মোবাইল ফোনের মধ্য দিয়ে। ছোট্ট যন্ত্রটির ক্ষমতা অনেক।
সাক্ষী নেই, সাথী নেই, একা একা যা ইচ্ছা শুনা, যা ইচ্ছা দেখা যায়। টেলিভিশনের সামনে
একা একা সব দেখা যায় না বা তা দেখার ব্যবস্থাও নেই। টেলিভিশন ছাড়া যে জীবন অচল, অকেজো হায়রে
বাঙালি। কিছুদিন আগেও বাড়ির সব সদস্য একসঙ্গে বসে টেলিভিশন দেখতে পারত। যদিও তারও
কোন মানে ছিল না। কিন্তু প্রশ্ন এই একা একা, সাথী ছাড়া, সাঙ্গপাঙ্গ ছাড়া
কী শুনি বা কী দেখি আমরা! উত্তর হতে পারে আমার খুশী আমি দেখব, যা খুশি তা দেখব।
দেখুন, দেখুন। আপনাকে না দেখানোর জন্য এ লেখা নয়। কথা হল কী শুনছেন, কি ভাষা শুনছেন
আপনি। আপনার কান দুটি কোন ভাষা শুনে অভ্যস্থ হচ্ছে।
হিন্দি একটা ভাষা। একটা রাষ্ট্রের
ভাষা। এবং যার যার ভাষা তার তার কাছে অত্যন্ত প্রিয় যে বলা অনাবশ্যক। এও আমরা
জানি ঐ ভাষাকে ঘিরে তার গান,
ছবি, নৃত্য আজ পৃথিবী গ্রাস করে চলেছে।
প্রতিবেশী বাংলাদেশ তার প্রথম খাদ্য হবে ভৌগলিক এবং ঐতিহাসিক ভাবেই তা সত্য।
এইখানটাতেই বাঙালির প্রথম বিপদ। বিষয়টি আমরা বুঝেছি কিনা-বিশেষত অভিভাবকবৃন্দ
বুঝেছেন কিনা। এই ভাষার গান,
ছবি, নাটক, কার্টুন কুড়ি থেকে পঁচিশটা চ্যানেল
জুড়ে বসে তাবেদারী করছে আর আমরা পয়সা দিয়ে কিনে তাকে ঘরে ঢোকাচ্ছি। ফলটা কি
ভেবে দেখেছেন? এতগুলো চ্যানেল থেকে এত সুন্দর চেহারার মানুষদের অন্যভাষার কথন, সুর ভঙ্গি, প্রস্বর আমাদের দুই
কান দিয়ে মর্মে যে চলেছে তার কী ফল নেই। ধুলিবালি ঝেড়ে ফেলার মত ঝাড়াঝাড়ি করলে
ল্যাঠা চুকবে ভাবছেন? না এ আঠা লাগলে সহজে আলাদা হবার নয়। মনুষ্য শক্তি এবং তার
ইন্দ্রিয় শক্তির ভিতর আরেকটি কিছু তৈরি হবে এবং আবার কথাতেই বের হবে। এটি ভাববার
কারণ নেই, অনেক হিন্দি গান,
নাটক ইত্যাদি দেখি-কিন্তু আমার তো
ক্ষতি হচ্ছে না। কিংবা আমি তো অবাঙালি হয়ে যাচ্ছি না। এতটা সহজ সমাধান এর মধ্যে
নেই। এতটা কাঁচামাল আপনার ভিতরে প্রবেশ করছে অথচ আউটপুট থাকবে না -হয় কী করে!
শব্দটা নিজে বললে পরিবর্তন মনে হবে
না। আর শব্দটা ঘিরে বাকী অন্য সবকিছুর পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে এবং তা অবশ্যম্ভাবী
হয়ে। এ যে ধরা পড়বে আমাদের কাছে তারও যে জ্ঞান থাকা চাই। ভাষা প্রকাশের
ধরণ-ধারণটাতে প্রথম আঘাত। বাংলা প্রকাশের অত্যন্ত নম্র মাধুর্যময় স্বরের বদলে
জায়গা পেয়েছে হটকারী প্রকাশ। এইটি বাংলা নয়। শিশুমন থেকেই যদি নিজের বাংলার
জায়গায় প্রবেশ করে অন্য স্বরভঙ্গি; তবে সে আঘাত জাতিসত্তার আঘাত বলাতো
ঠিক।
একটা মোটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।
আজকাল মাধ্যমগুলি সব শিক্ষিত বাঙালিগণ ছ্যা ছ্যা বা ছ্যান ছ্যান করেন। ক্রিয়াপদে
অ্যা কোত্থেকে এলো। হওয়ার কথা-হয়েছে, করেছে, বলেছে সবই তো এ-কার। কিছু তরুণদের
দাবী আধুনিকতা। মানতাম যদি না নিজেকে বিকিয়ে হত। নিজেরটুকু খুইয়ে আধুনিকতা
প্রকাশ করবে কি দিয়ে। অন্যেরটা দিয়ে? যেমনটি ইংলিশ মিডিয়াম? এ বিষয়গুলি নিয়ে
রাষ্ট্র কি ভাবছে? কিংবা বালির ঢিবির মত সাজানো ঘরে ঘরে একাডেমিগুলি? কিংবা সাংস্কৃতিক
কর্মীরা? অবশ্য সাংস্কৃতিক কর্মী কিংবা সাহিত্য কর্মীদের একটা সমস্যা আছে সে
কথা আগে মানতে হবে। তাদের ধরণটা বোঝা যায় না। ঘরের বাইরে বাংলার ধ্বনি তোলেন আর
সন্তানদের ইংলিশ মাধ্যমে পড়ান। এভাবেই বাইরে সামাজিক আন্দোলনের মানুষটির ঘরে
স্টার প্লাস ছাড়া ঘুম আসে না। এই দ্বিবিধ চরিত্রকে সরাতে হবে। ইংরেজি শিক্ষায়
দোষের কিছু থাকবে কেন? সে ভাষাতো জানতে হবে কিন্তু বাংলাকে অবহেলা করে-দ্বিতীয়া করে নয়।
ইংলিশ মাধ্যম স্কুলগুলিতে কতটা ঠিক ঠিক ইংলিশ চলে তাও তো জানা চাই। আমার কাউকে
শ্রদ্ধা করতে আপত্তি নেই তবে মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করে নয় কখনও। ইংলিশ মিডিয়ামের
দৌড় এখন থানা পর্যন্ত গড়িয়েছে-শিক্ষা যাই হোক। রবীন্দ্রনাথের তোতা কাহিনীর
পাখির শিক্ষার মত। গেলাতেই হবে-বাঁচুক আর মরুক। এ বিষয়গুলি সরকারের একটু ভাবা
দরকার। এত ইংলিশের চাপ হলে বাংলাদেশের সব স্কুল ইংলিশ মিডিয়াম হতে পারে। সঙ্গে
একটা বাংলা ব্যবস্থাও থাকবে। বাংলাতে উত্তীর্ণ হলেই কেবল দুটি সার্টিফিকেট পাবে।
নতুবা নয়।
বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলতো আজকাল
বাংলার রূপ পাল্টিয়ে চলেছেন,
যেমন-‘আমাকে শুনতে পাচ্ছেন?’ ‘আমাকে ভোট করবেন।’
ইংরেজির অনুবাদ। বাংলার চাটনি।
এবার আসা যাক দ্বিতীয় আক্রমণ পর্বের
কাহিনী-শর্ষের ভিতরে ভূতের বাস। হঠাৎ বাংলাদেশে টেলিভিশনগুলোর নাটকের ভাষার
পরিবর্তন। আঞ্চলিক ভাষায় অনেক নাটক পূর্বের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশী হচ্ছে, হোক। সেতো আমাদেরই
আদি ভাষা, উপভাষা। যদিও পরিচালককে ভাবতে হবে। নোয়াখালীর ভাষায় নাটক করলে
দিনাজপুরের লোকজন কি করবে? কথা তা নয়। কথা হল এর বাইরেও নতুন একটা ভাষার আবিষ্কার হয়েছে তা
দিয়েই এখন মুড়ি-মুড়কির মত নাটক চলছে। ভাষাটি ব্যাকরণে ফেলা যায় না। তবে চলিত
এবং আঞ্চলিকতার মাঝখানে কথোপকথনের জন্য এক ধরণের ভাষা। টেলিভিশনগুলির কিছু পরিচালক
এই কাজটি করছেন এবং নিজেরাই বলছেন যুগান্তকারী কাণ্ড ঘটিয়ে দিয়েছেন। হ্যাঁ
বাংলাকে বারটা বাজানোর জন্য যুগান্তকারীই বটে। তাদের মত্ হল যে, এই ভাবেই কথা বলি
আমরা। সকলে এ ভাষাতেই কথা বলেন। কিন্তু সেতো কেবল কথা। কথা তো একা একা সাহিত্যের
নয়, কথার সমষ্টি সাহিত্য।
একজন-অন্যজনের কথোপকথনে যে ঘটনা ফুটে
ওঠে-তা নাটকে দেখানো মানেই সাহিত্য। নাটক নিজেই সাহিত্য। সাহিত্য তো সকলের জন্য
এবং মান ভাষাতেই নিবেদন যোগ্য। এতো একা একা খিচুরী করবার জন্য নয়। যদিও টেলিভিশনে
যা হয় তাকে ড্রামা বলা যায় অবশ্যই থিয়েটার নয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন
আরেকটি কাঁটা রেডিও এফ.এম. ভাষা। এই সবকে জেনে বুঝে ভাষার প্রতি আক্রমণ বলা যায়।
আক্রমণরূপ কেবল ভিন্ন ভাষা থেকে হচ্ছে এমন নয়। এরও প্রতিকার চাই। প্রতিহত করা
চাই। নইলে বাংলা ভাষা দুঃখিনী বাংলা থাকবে চিরকাল।
( গোলাম সারোয়ার, উচ্চারণ বিষয়ক প্রশিক্ষক, আবৃত্তিকার, নাট্যশিল্পী ও
সংস্কৃতিকর্মী )
No comments:
Post a Comment