নান্দনিক প্রযোজনা ও নাটকের আবৃত্তি

আবৃত্তি প্রযোজনা সম্পর্কে নানাজনের নানারকম ধারণা প্রচলিত আছে। পর্যন্ত কোন একটি ধারণাকে দৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত বা সংজ্ঞায়িত করা হয় নি। কারো মতে, একটি সুনির্দিষ্ট বক্তব্য সংবলিত কবিতার গ্রন্থনা ব্যতীত আবৃত্তি প্রযোজনা হতে পারে না। ভিন্ন মত হলো, সাহিত্যের যে কোন উপাদানের স্মৃতি নির্ভর পাঠ বা নান্দনিক উচ্চারণ সুগ্রন্থিত বা বক্তব্য-সমৃদ্ধ হলে তাকে আবৃত্তি প্রযোজনা নামে অভিহিত করা যায়। এরূপ বহুমুখী ব্যাখ্যা বা যুক্তি দ্বারা আবৃত্তি প্রযোজনার প্রকৃত রূপ সম্পর্কে বিতর্ক চলে আসছে। এসব বিতর্কের অবসানকল্পে বাংলাদেশের আবৃত্তি ক্ষেত্রের সামগ্রিক রূপকল্প তা বাস্তবায়নের পন্থা অনুসরণের দায়িত্ব গ্রহণ করা একান্ত জরুরি। উপর্যুক্ত বিষয়টি অনুধাবনের দায়িত্ব এদেশের আবৃত্তি দলগুলোর কর্তাব্যক্তি নির্দেশকদের কাঁধে যেমন, তেমনি সকল দল সমন্বয়ে গঠিত শক্তিশালী ফোরামের নেতৃত্ব গ্রহণকারীদের উপরও বর্তেছে। তারা তাদের উপর অর্পিত কর্ম সম্পাদনে কি পরিমাণ আন্তরিক তার উপর নির্ভর করছে আমাদের আবৃত্তির ভবিষ্যৎ। তবে চলমান সময়ের আবৃত্তি আন্দোলনের প্রধান অনুসঙ্গ আবৃত্তি প্রযোজনা হওয়ায় এটিকে অবহেলা করার কোন সুযোগ থাকছে না


প্রযোজনা শব্দটির ব্যবহার রেডিও, টেলিভিশন, সিনেমা, মঞ্চনাটকের সীমানা ছাড়িয়ে আবৃত্তিতেও যুক্ত হয়েছে। পূর্বে একক দলবদ্ধভাবে আবৃত্তি করলে তাকে একক আবৃত্তি বৃন্দ আবৃত্তি রকম দুটি নামে অভিহিত করা হতো। এখন একক বা দলবদ্ধ দুটি ক্ষেত্রেই প্রযোজনা শব্দটির বহুল ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। যে কোন ধরণের আবৃত্তির প্রাথমিক শর্ত হলো বিষয় নির্বাচন। যে বিষয়টিকে উপস্থাপন করা হবে সে সম্পর্কে সুষ্পষ্ট ধারণা থাকলে তার গ্রন্থনা সম্পাদনা করা সহজ হয়ে ওঠে। সুগ্রন্থিত সংযমী সম্পাদনা-ক্রিয়া সম্বলিত প্রযোজনার বাঁধন আঁটসাট থাকে। স্বরের প্রকৃতি বাচন ভঙ্গি অনুযায়ী পারফর্মার নির্বাচন প্রক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। এক্ষেত্রে সামান্যতম পক্ষপাতিত্ব ত্রুটি সমগ্র প্রযোজনার মান অবনয়নে ভূমিকা রাখে। প্রস্তুতিপর্ব চলাকালীন অনুসঙ্গের কথাও ভেবে নিতে হয়। আজকাল আবৃত্তি প্রযোজনাতে আলো, পোশাক, সেট, মিউজিক লক্ষণীয় কার্যকরভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। মূল বিষয়বস্তু বা কাব্যবস্তুটির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বাস্তবানুগ অনুসঙ্গ ব্যবহারে দক্ষতার পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। অন্যথায় প্রযোজনাটি শ্রুতিসুখকর দৃষ্টিনন্দন না হয়ে ক্যারিক্যাচার সমৃদ্ধ হাস্যকর সার্কাসে পরিণত হবে। এর ফলে প্রযোজনা উপস্থাপনের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। একটি প্রযোজনার মূল লক্ষ্য হলো তার বক্তব্যকে প্রাণবন্ত করে শ্রোতা-দর্শকের নিকট উপস্থাপন করা। সাহিত্যের যে সকল উল্লেখযোগ্য পাঠ মানব মনে সঞ্চারণ করা প্রয়োজন সেগুলোকে মানসম্পন্ন বাচনশৈলীর সাহায্যে উপস্থাপনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা দরকার। অনুশীলন মানুষের রুচির স্তর উন্নীতকরণ, মানবিকতা চর্চার পথ উন্মুক্তকরণ তার বিকাশের জন্য সহায়ক হয়ে উঠে। আমাদের কমিটমেণ্টের কোন অভাব নেই। কিন্তু কোন্ পদ্ধতি অনুসরণের ফলে শিল্পরীতি অক্ষুণ্ন রাখা যায় এবং নতুনতর সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়, সে সম্পর্কে সুষ্পষ্ট জ্ঞানের অভাব রয়েছে। ফলে আবৃত্তি প্রযোজনার দ্বারা প্রায়শ ব্যাপক হারে দর্শক শ্রোতাকে আকৃষ্ট করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে কোন কোন আবৃত্তি প্রযোজনা মাইল ফলক হিসাবে দেশের আবৃত্তির বিস্তারকে অনেক দূর পর্যন্ত টেনে আনতে সক্ষম হয়েছে কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সম্ভব হলে দেশের আবৃত্তির অঙ্গন নিঃসন্দেহে আরও সমৃদ্ধ হবে। কোন আবৃত্তি প্রযোজনা মানুষের মনে প্রতিক্রিয়া ঘটালে তাৎক্ষণিকভাবে বুঝতে পারা যায়। আবৃত্তির গতি-প্রকৃতির সাথে সাথে উপস্থিত শ্রোতাও উদ্বেলিত হয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পারে। দেশ, মানুষ সমাজের স্পর্শকাতর বিষয়গুলি সঠিক প্রাঞ্জল উপস্থাপনার দ্বারা ব্যক্ত করলে মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগ স্থাপিত হয়। রকম বেশ কিছু প্রযোজনা দেশের আবৃত্তির জগতকে প্রসারিত করেছে। প্রসঙ্গত মানুষেরা মানুষের পাশে  ভাষার লড়াই আবৃত্তি পালা প্রযোজনা দুটির নাম উল্লেখ করা যায়। প্রথমোক্ত প্রযোজনায় অসহায় মানুষের বঞ্চনার বিবরণ, তাঁদের প্রতিরোধ স্পৃহা জাগরণের কথাগুলি মর্মস্পর্শী বর্ণনায় প্রাণবন্ত করে তোলা হয়েছে। পারফর্মার সিলেকশন, গ্রন্থনা, কোরিওগ্রাফি, মিউজিক, আলো পোশাকের ব্যবহারের চমৎকারিত্ব দর্শক-শ্রোতাকে বিমোহিত করে। আবৃত্তি শিল্পীদের শারীরিক ছন্দ কাব্যবস্তুর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় সে প্রযোজনাটিকে সার্থক করে তুলেছে। ভাষার লড়াই আবৃত্তি পালা প্রযোজনার নির্দেশনা কর্মের সাথে যুক্ত থাকার সুবাদে এর প্রতিটি মঞ্চায়নে শ্রোতা-দর্শকের তাৎক্ষণিক উপলব্ধির তরঙ্গ অবলোকন করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। বাংলা ভাষার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস নিজ ভাষাকে অবলম্বন করার জন্য হাজার বছরের সংগ্রামের ইতিহাসভিত্তিক একটি সাধারণ দীর্ঘ ছড়া প্রযোজনার বিষয়বস্তু। ছড়াকারের ইঙ্গিত অনুসরণ করে দেশাত্মবোধক সংগীত দেশজ আঙ্গিকের কোরিওগ্রাফির সংযোজন প্রযোজনার মানকে যৌক্তিক পর্যায়ে উন্নীত করে। যাবৎ দেশের বিভিন্ন স্থানে আবৃত্তি প্রযোজনাটি এগারোবার মঞ্চায়ন হলেও দর্শক-শ্রোতার আকর্ষণের তীব্রতা কমতে দেখা যায় নি। উপস্থাপন রীতির সৌকর্যের কারণে একটি সাধারণ মানের স্ক্রিপ্ট মানব-হৃদয়ে অনন্য প্রতিক্রিয়া ঘটাতে সক্ষম হয়। আমাদের বাচিক মাধ্যম মোটেই দুর্বল নয়। সঠিক প্রয়োগকৌশল উদ্ভাবনের দ্বারা যে কোন আবৃত্তি প্রযোজনার সার্থক রূপায়ণ সম্ভব
() কবির একান্ত অনুভূতি ভাবনার প্রতিফলন ঘটে তার কবিতায়। ভাব রস ছন্দ অলঙ্কারের মাধ্যমে কবির অন্তর্লোকের আনন্দ বেদনা সুখ দুঃখের ছবি ফুটে উঠে। পাঠক যখন কবিতা পাঠ করে, তখন তার মধ্যে জেগে উঠে অপর একটি অনুভূতির শিহরণ, মস্তিষ্কে জাগ্রত হয় আরেক ধরণের গভীর কোন চিন্তা। কবি এবং পাঠকের মনে অনুরূপ ভাব চিন্তার প্রতিফলন ঘটার নিশ্চয়তা দেওয়া সম্ভব নয়। তবে কবিতার বিষয়বস্তু বক্তব্যের মূল সূত্রটি অনুসরণ করলে দুজনের মধ্যে একটি মেলবন্ধন আশা করা যায়। একজন আবৃত্তিকার যখন কবিতাটি পাঠ করে শোনাবেন তখন শ্রোতাদের মধ্যে ভিন্নতর কোন প্রতিক্রিয়া ঘটতে পারে। এসব ক্ষেত্রে প্রায়শ কবির আশাতীত অতিরিক্ত ব্যঞ্জনা সৃষ্টি হতে দেখা যায়
শুধু সাহিত্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে নাটক লেখা হয় না। সেটিকে অভিনয়ের মাধ্যমে মঞ্চে দর্শকের সম্মুখে উপস্থাপন করাই মূল লক্ষ্য থাকে। সে জন্য নাট্যকার নাটকটিকে সাজান দর্শকের কথা মাথায় রেখে। একজন নির্দেশক নাটকটিকে নিজস্ব ভাবনার মাধ্যমে নতুন রূপে উপস্থাপনের জন্য প্রস্তুত করেন। নট-নটির বাচিক শারীরিক অভিনয়, নৃত্য-গীত, বাদ্য যন্ত্র, আবহসঙ্গীত, সেট আলোক ইত্যাদির মাধ্যমে নির্দেশক নবতর শিল্প সৃষ্টির প্রয়াস চালান যা নাটক পাঠের সময় অনুভূত হয় না
মঞ্চনাটকে বাচিক অভিনয় ছাড়াও শিল্পী চক্ষু, মুখমন্ডল, হাত-পা সমগ্র শরীরকে ব্যবহার করতে পারেন। কথা বলার সময় বিরতিতে হাঁটাচলা, উঠাবসা, দৃষ্টি নিক্ষেপ, দৃষ্টি বিনিময়, হাত-পা শারীরিক ইঙ্গিত ইত্যাদির সাহায্যে অভিনয় করে থাকেন। তাতে তিনি অভিনয় মঞ্চের পরিপূর্ণ ব্যবহারের এবং আবহসঙ্গীত আলোর সঙ্গে ঐকতান সৃষ্টির সুযোগ পান
নাটক বা কাব্যনাটকের শ্রুতিরূপ উপস্থাপনের রীতিটিকে আবৃত্তিরই ভিন্নরূপ বলা যায়। এক্ষেত্রে শিল্পী কেবল স্বর প্রক্ষেপণের দ্বারা অভিনয় করার সুযোগ পান; চক্ষু, মুখমন্ডল, হস্তপদ এবং শরীরের ব্যবহার প্রায় নাই বললেই চলে। কিন্তু দর্শক উপস্থিতিতে বাচিক অভিনয় করতে হয় বলে একেবারে নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টি শারীরিক ভাব প্রদর্শনের সুযোগ নাই। ফলে তাকে চক্ষু, হাত শরীরের মাধ্যমে অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলতে হয়। তবে সেটি কোনক্রমেই মঞ্চাভিনয়ের মত হবে না। কবিতা আবৃত্তির ক্ষেত্রে আবৃত্তিকারকে যে ধরণের শারীরিক ছন্দ প্রদর্শন করতে হয়, নাটকের শ্রুতিরূপ উপস্থাপনের ক্ষেত্রে অনুরূপ অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটে। সুতরাং মঞ্চাভিনয়ের স্বরক্ষেপণ এবং শ্রুতিরূপের স্বরপ্রক্ষেপণের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য থাকে। মঞ্চাভিনয়ে চরিত্রানুগ বাকভঙ্গি প্রয়োগ করতে হয়, শ্রুতিরূপে সুর গতির সমন্বয়ে ভিন্ন ধরণের বাকভঙ্গি প্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে। রেডিও নাটকে অভিনয় এবং মঞ্চে শ্রুতিরূপের ক্ষেত্রেও বাকরীতির পার্থক্য নির্ণয়ের প্রয়োজন রয়েছে। কেননা রেডিওতে শুধু দূর থেকে কানে শোনার উপর নির্ভর করতে হয় শ্রোতাকে। কিন্তু মঞ্চের শ্রুতিরূপ শ্রোতার সম্মুখেই উপস্থাপিত হওয়ার ফলে শ্রোতার মানসিক অবস্থান একই থাকে না। যেমন টেলিভিশনের নাটক মঞ্চ নাটকের পরিবেশ অবস্থানের ভিন্নতার কারণে বাকভঙ্গি উপস্থাপন রীতিতে ব্যাপক পার্থক্য বিদ্যমান
মঞ্চনাটক এবং মঞ্চ শ্রুতিরূপের মাধ্যম ভিন্ন হওয়ায় একই শিল্পীকে একই নাটকে ভিন্নতর বাকভঙ্গি স্বরভেদের প্রয়োগ ঘটাতে হয়। ব্যাপারটি সম্পর্কে সুষ্ঠু প্রায়োগিক ধারণা না থাকার ফলে অনেক প্রয়োগকর্মী বিভ্রান্তিতে পড়েন। একজন মান সম্পন্ন অভিনেতা যেমন ভাল আবৃত্তি করতে পারবেন তার নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না, তেমনি উঁচুদরের কোন আবৃত্তিকার অভিনয় কুশলী হবেন সে কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় না। তবে অনেকেই আছেন যারা আবৃত্তি নাটক উভয় মাধ্যমে চর্চা নিষ্ঠার দ্বারা সমান দক্ষতা প্রদর্শনে সক্ষম হন
নাট্যাভিনয় দেখা শোনার ব্যাপার হলেও আবৃত্তি শুধু কানে শোনার বিষয়। মঞ্চে সাধারণত অভিনেতাকে চলমান অবস্থায় দেখা যায়, অথচ আবৃত্তিশিল্পীকে নিশ্চলভাবে উপবিষ্ট বা দন্ডায়মান অবস্থায় দেখা যায়। সেক্ষেত্রে আবৃত্তিশিল্পীর কণ্ঠনিসৃত বাণী শুনলেই চলে না, তাকে তাকিয়ে দেখতেও হয়। কিন্তু তার বক্তব্যের সাথে শারীরিক ছন্দের সাম্য লক্ষ্য করা যায় না। এক্ষেত্রে একজন শ্রোতা তাকে যেভাবে দেখতে পান, কথাগুলো ঠিক সেরকমভাবে শুনতে পান না। কেবল কানে শুনে কথার ছন্দ, অর্থ ভাব শ্রোতাকে অনুধাবন করতে হয়। সে জন্য আবৃত্তিশিল্পীর কণ্ঠস্বরের প্রস্তুতি, স্বর প্রক্ষেপণরীতি, ভাব-রস-ছন্দ জ্ঞান, নির্মাণ কৌশল ইত্যাদির ব্যাপারে অতিমাত্রায় সচেতন হতে হয়। শ্রোতার কর্ণকুহরে মর্মবাণী পৌঁছে দেওয়ার মত সার্থক প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়। কিন্তু অভিনয়শিল্পীকে শুধু স্বরের উপর নির্ভর করতে হয় না। তাই একই নাটকের অভিনয় আবৃত্তির ক্ষেত্রে বাকরীতি, বাক প্রক্ষেপণ উপস্থাপন কৌশলের বৈচিত্র থাকা বাঞ্ছনীয়

(মীর বরকতউচ্চারণ প্রশিক্ষক, আবৃত্তিকার, নির্দেশক, সংস্কৃতিকর্মী )

No comments:

Post a Comment