ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসাবে
এবং তারও পূর্বে মাদারীপুর নাজিমউদ্দিন কলেজের অধ্যাপক হিসাবে শ্রেণীকক্ষে নরেন
বিশ্বাসের পাঠদান রীতি আজকের আলোচ্য নয়। আলোচনা করবার প্রচেষ্টা থাকবে তাঁর ভিন্ন
ভিন্ন আবৃত্তি-নাটক বা উচ্চারণ সম্বন্ধীয় প্রতিষ্ঠানে উচ্চারণ বিষয়ক বক্তৃতার
রীতিকে আবিষ্কারের। কী করে এই রসহীন শুষ্ক প্রায় তামাটে ইচ্ছাকে তিনি জাগ্রত
করতেন তাঁর বক্তৃতার মধ্য দিয়ে। কি করে অর্থ-যশহীন উচ্চারণ-শিক্ষণ এই পথকে
জনপ্রিয় করে তুললেন অন্তত দেশের একটা বয়সের একটা সময়ের অনেক মানুষের মধ্যে।
আমিও তার মধ্যে একজন । কণ্ঠশীলনে ভর্তি পরীক্ষার সময়ে তাঁর সাথে পরিচয়। দেখলাম
প্রথম-পানের সাথে কথার কিংবা কথার সাথে পানের এক অদ্ভুত সম্পর্ক।
সেই ১৯৮৫
ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৯৮-এর ২৭ নভেম্বর। জানা-চেনা-বোঝাবুঝির অন্বিষ্টে সম্পর্কবোধ
যেখানে থাকে থাকুক তা প্রকাশ্যেও নয় লিখিতব্য নয়-এবং মাপামাপির খামখেয়ালী দর্শন
থেকেও অনেক দূরে বসে উপলব্ধি করতে চাই, বিশ্লেষণ করতে চাই-তাঁর কাজকে, তাঁর পাঠকে, তাঁর সাধনাকে। বেশ
বলিষ্ঠ, দানাদার এবং গমগমে ধ্বনিটিকে অত্যন্ত স্থির রেখে বক্তৃতা আরম্ভ করতেন
তিনি। শব্দ থেকে শব্দে টেনেটেনে শ্রোতার কানে মনে প্রথম সুর প্রথম মন্ত্রের এক
আবেশ ছড়িয়ে দিতেন। ধীরে ধীরে যেন শ্রোতা প্রতি শব্দে-শব্দে আনন্দে-আনন্দে এগিয়ে
যেতে পারেন বক্তারই সাথে। যদিও নিম্নস্বরটি তাঁর খানিক পরেই মধ্য অবস্থানে চলে যেত
এবং তারও পরে প্রায় তারার দিকে চলত। কিন্তু অবিশ্বাস্য অনুরণনের প্রবল প্রতাপে
তাঁর স্বরের গমগম মনোহরণ ধ্বনিসমূহ একটুও তাল হারাতে পারত না। শুভেচ্ছা জানাতেন
একটি শব্দের ওপর গুরুত্ব রেখে,
তাঁরই একটি সৃষ্টিকে সহজিয়া করতে। ‘বাকশিল্পাঙ্গনে’ তোমাদেরকে
শুভেচ্ছা। বাকশিল্পাঙ্গন, বাকশিল্প -এই শব্দগুলির আবিষ্কার এবং প্রয়োগ দুই বিভাগেরই কর্তা
নরেন বিশ্বাস। বাক্-এ, কথনে কিংবা বাচিক কোন উচ্চারণের প্রকাশে এক অনন্য সৌন্দর্যে প্রকাশ
ঘটাতেন তিনি। তাই এই অঙ্গনের নাম দিয়েছিলেন বাকশিল্পাঙ্গন। পরিষ্কার জানাতেন তিনি
বক্তৃতার আরম্ভেই ‘এই উচ্চারণ ক্লাস উত্তীর্ণ হলেই, একটি অভিজ্ঞান উপস্থাপন করলেই, টেলিভিশন কখনও বলবে
না-আসুন আসুন অথবা বাংলাদেশ বেতার বলবে না-আসুন আসুন।’ জানাতেন-‘প্রথম দিনেই
তোমাদের ভয় ধরিয়ে দিতে চাই না,
কেবল সত্যটি বলতে চাই।’ এও জানাতেন কেউ যদি
ভেবে থাক টিভি, বেতারই তোমাদের উদ্দেশ্য তবে তাদের জন্য বলতে পারি-
‘হেথা নয় হেথা নয় অন্য কোথা অন্য
কোন্ খানে।’
স্পষ্ট মতামত, স্পষ্ট ভবিষ্যতকে
পর্যবেক্ষণে রেখে, অতীতের অভিজ্ঞতার উপর ভর রেখে এই প্রকাশ তাঁর। প্রথম শ্রোতা, প্রথম পাঠের
শিক্ষার্থী এই বক্তৃতায় হয়ে উঠে যেন আরও স্বচ্ছ নিজের কাছে, কাজের কাছে এইতো
অধ্যাপক নরেন বিশ্বাসের ভাবনা-নির্ভীক, নিঃশঙ্ক।
বিষয়টি গভীর, অর্থ-সুরও গভীর, হয়ত শক্তও যথেষ্ট
কিন্তু বলাটায়-কওয়াটায় অর্থাৎ প্রকাশে ধ্বনির কোন অংশে তার ছিটে ফোঁটাও রাখতেন
না তিনি। কঠিন-গরল বুঝতে না দেয়ার সহজাত গ্রামীণ এক আন্তরিকতা তাঁর শব্দ গঠনে এবং
উচ্চারণে মজবুত করতে পারত শ্রোতার মন-মানস। বলতেন তিন ম-কে জানা চাই সর্ব প্রথমে।
‘মা, মাটি, মাতৃভূমি, হয় না ঋণ শোধ
তাদের কোন কালে।’
কথা হলো, নরেন বিশ্বাস জেনে
বুঝেই প্রকাশের এই পথটিতে গেলেন কেন? কারণ তিনি ভালই জানতেন, শব্দগুলির অর্থকে
যতই শৈল্পিক করা যাক, যতই সাহিত্যিক-মাহাত্ম্যকে প্রতিষ্ঠা করা যাক তাতে পাতা-কালি যতটা
সিক্ত হবে তার উচ্চারণ শিক্ষার্থীরা ততটা হবে না। ফলে এমন পথ আবিষ্কার করলেন যে
পথে বাংলা উচ্চারণের ক্লাসের শিক্ষার্থী কেবল নয়-তাঁরাও এসে বসতেন শুনতেন স্যারের
বক্তৃতা। কারণ এওতো বিদিত যে উচ্চারণ শুদ্ধতার প্রবল ঝোঁক যে তরুণ-তরুণীদের কাছে
প্রতিষ্ঠিত হল আজ-তার প্রধান কারণ এক উপযুক্ত সহজিয়া সাধক। ব্যাকরণের কসরতের
ধাপগুলির প্রকাশ-মুখায়ব যদি ক্লান্তিকর হত তবে আজ বাচিক সাহিত্য অনাদরেই থাকত
পূর্বের মত। বক্তৃতার ধরনে নতুন জীবন, নতুন মান শহরের সাথে গ্রামের দূরত্বের
সঙ্কোচন সুর তাঁর জিহ্বা নিঃসৃত কথনে পরিষ্কারভাবে প্রকাশিত হতো।
পাঠের সাথে শিক্ষার্থীর সংযোগ ঘটাতেন
তিনি অনিবার্য ভাবে। কোন লুকোচুরির, ঘুমানো, মনোবিয়োগ ঘটতে পারত না তাঁর ক্লাসে।
পাঠদান মাত্র কিছু জিজ্ঞাসা ছুঁড়তেন তিনি শিক্ষার্থীদের মাঝে। যেমন--
ক) পরিষ্কার ?
খ) তোমরা জানো কিনা জানি না-
গ) অতএব,
ঘ) কী বল ?
ঙ) স্মৃতি যদি প্রতারণা না করে;
ইত্যাদি শব্দ অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকদের
মুদ্রায় দাঁড়ায়। যদি এক রকম হয়ে যায় মুদ্রাদোষে কখনও-নরেন বিশ্বাস সজাগ থেকে
শব্দগুলির ব্যবহার করতেন নানা সময়ে নানাভাবে। ফলে এক রকম না হয়ে আরেক অর্থ
দাঁড়াত শিক্ষার্থীর কাছে, শিক্ষার কাছে বারবার।
উচ্চারণ পাঠ্য বিষয়ের বিস্তারিত
আলোচনার পূর্বে ভূমিকায় তিনি উচ্চারণের ৫ (পাঁচ) সমস্যাকে নিয়ে আলোচনা করতেন এবং
তার মধ্যে ৫ নং সমস্যাকে জাতীয় সমস্যা হিসাবেই উল্লেখ করেছেন একাধিকবার।
১ নং সমস্যা :
বাংলাভাষার লিখিতরূপ এবং উচ্চারণরূপ
এক নয়-
শব্দের মূল অবস্থান থেকে ক্রমাগত বদলে
শেষ অবস্থানে এসে একই ধরনের বানানের শব্দ একাধিক উচ্চারণে ব্যবহার হচ্ছে।
যথা - বিশ্ব=বি+শ্+শো
বিদ্বান=বি+দ্+ দান
মঞ্চ=(ম+ঞ+চ)=মন্-(চো)
দ্বন্দ্ব=দন্+দো
উজ্জ্বল=উজ্+জল
আত্ম=আত্+তোঁ ইত্যাদি।
২ নং সমস্যা
বাংলা ভাষায় বর্ণ একাধিক, ধ্বনি এক আবার বর্ণ
এক ধ্বনি একাধিক।
যথা : স, শ, ষ = এক শ
উপমা দিতেন সব শালাই এক শালা অর্থাৎ
ঘর হোক, আত্মীয় হোক উচ্চারণে তফাৎ নেই। ণ, ন = এক ন; জ, য = জ। জ-এর ধ্বনি
নিয়ে উপমা দিয়েছেন যম আর জামাই চেহারাতে যতই অন্য রকম থাকুক না কেন চরিত্র তাদের
একই এবং তাদের স্বাস্থ্য যাই হোক না কেন একই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারে তারা।
অন্যদিকে : একটি = এক + টি
একটা = অ্যাক্ + টা
কব = ক + বো
কবি = কো + বি
এ-ই অ্যা, আবার ক-ই কো। নরেন
স্যার প্রমাণ করছেন এটিই একটি বড় সমস্যা।
৩ নং সমস্যা :
মহাপ্রাণ এবং অল্পপ্রাণের তফাৎ করতে
না পারা। এই সমস্যা নিয়ে খুবই মজাদার এবং চিরন্তন সত্যের মত কিছু কথা বলতেন। যথা
:
১) মেঘের কোলে রোদ হেসেছে
বাদল গেছে টুটি
আজ আমাদের ছুটি ও ভাই
আজ আমাদের ছুটি
মহাপ্রাণ অল্পপ্রাণ উল্টে গেলে হয় :
মেগের কোলে রোদ এসেছে
বাধল ঘেচে ঠুঠি
আজ আমাদের চুঠি ও বাই
আজ আমাদের চুঠি
অপূর্ব এক দোলনে বলতেন তিনি কথাগুলো।
মুহূর্তে শিক্ষার্থীর সমস্ত জড়তা, বিষন্নতা এক প্রসন্নতায় ভেসে উঠত।
২) গল্পের আরম্ভ করতেন, একদিন এক ছেলে ও এক
মেয়ে স্যারের সঙ্গে কথা বলতে এলেন। স্যার জিজ্ঞাসা করলেন তোমার দেশ কোথায়? ছেলেটি বলল-বোলা, স্যার আবার বললেন
তোমার সঙ্গে কে? ছেলেটি বলল- ভোন। মেয়েটি একই সঙ্গে বলে উঠল হ্যাঁ স্যার আমরা
বাই-ভোন। সমস্ত ক্লাস ফেটে পড়ল হাসিতে। শিক্ষায় শিক্ষা হলো পর্যাপ্ত ভাবে এবং
আনন্দও পেল সমস্ত শিক্ষার্থী।
এ প্রসঙ্গে আরেকটি উপমা যুক্ত করা
যায় তাঁর-একবার স্টুডিওতে রেকর্ডিং এ রাত হচ্ছিল। এক ছাত্রকে বললেন, ‘তুমি আমার বাসায়
যেয়ে আমার গিন্নিকে বলবে-আমার যেতে দেরী হবে, কেমন। এই খবরটা তুমি একটু কষ্ট করে
দেবে।’ ছেলেটি বলল-‘জি স্যার, জ্বি স্যার-আমি এক্ষুণি গিয়ে বৌদিকে কবর দিয়ে দিব।’ স্যার চোখ বড় বড়
করে তাকালেন-ছেলেটি আবার বলল ‘জ্বি স্যার-যেমন করেই হোক কবর আমি দিবই।’ স্যার তখন ক্লাসে
বলছেন-বুঝতে পারছ তোমরা? কী বলছে সে নিজেই জানে না। আমার একমাত্র গিন্নিকে একেবারে মেরে
ফেলতে চাইছে।
৪ নং সমস্যা : আঞ্চলিকতা
বাকশিল্পীর ব্যাখ্যায় অঞ্চলের ভাষা
অর্থাৎ গাঁয়ের ভাষা অর্থাৎ মায়ের ভাষা যা কিনা একান্তই আন্তরিক ভাষা তাতে সন্দেহ
নেই। আমাদের দেশের একটি ফিল্মের কথা ধরা যাক। ছবিটি রিলিজের পর সারা দেশের জেলায়, থানায় প্রদর্শিত
হয়। ছবিটি একটি জেলার ভাষার তৈরী করলে সব জেলার মানুষের জন্য বুঝতে পারা অসাধ্য
হয়ে উঠবে। কখনও কখনও একটি বা দুটি চরিত্রের কিছু অংশ আঞ্চলিক ভাষায় করা যায় তবে
সমস্ত ছবিটিকে একটা অঞ্চলের ভাষায় করলে অন্য অঞ্চলের জন্য অবিচারও হয়। এই জন্য
একটি মান ভাষা দরকার। চলিত এবং প্রমিত। ধীরে ধীরে অঞ্চলের ভাষাকে আঁচলে সযত্নে
রেখেই একটু সাধু ভাষা অর্জন করা চাই। এই দাবীকেই নরেন বিশ্বাস তাঁর বক্তৃতায়
ভূমিকা রাখতেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাবে।
৫ নং সমস্যা :
৫ নং সমস্যাকে স্যার জাতীয় সমস্যা
হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। বাংলা ভাষার প্রতি অবহেলা। ঔদাসীন্যই এই সমস্যাকে কেবল
বাড়িয়ে তুলেছে। বাংলা ব্যাকরণের সংজ্ঞাকে নিয়ে রীতিমত গবেষণা করেছেন তিনি। তাঁর
মতে ব্যাকরণে যা আছে তা কোন স্কুলে কিংবা কলেজে পড়ানো বা শেখানো হয় না-এইজন্য এই
শিক্ষাকে প্রতারণমূলক শিক্ষা দাবী করেছেন। ব্যাকরণে আছে- ‘যে পুস্তক পাঠ
করিলে বাংলা ভাষা শুদ্ধরূপে লিখিতে, পড়িতে এবং বলিতে পারা যায়, তাহাকে বাংলা
ব্যাকরণ বলে।’
কিন্তু বলার পরীক্ষাটি আমাদের দেশে
কখনও চালু হয়নি। এইটি চালু হলে এই দেশের মানুষের বাচিক সমস্যা বহু আগেই কমে আসতে
পারত। এই ব্যাখ্যায় নরেন বিশ্বাসের ক্ষোভও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। এই প্রতারণা ক্রমাগত
ছড়িয়ে পড়ে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে, শব্দে-শব্দে। সম্মানিত শব্দটিকে অনেকে
সন্মানিত বলছেন, অনেক সুখ্যাত মানুষজন বলছেন এই অবহেলা থেকেই। এ কথাতো ঠিক ইংরেজির
উচ্চারণ এবং বানান দেখতে যত তাড়াতাড়ি আমরা অভিধান খুলি বাংলার জন্য আমরা তা করি
না। এখানেও ঔদাসীন্য।
উচ্চারণ সূত্রে প্রবেশের মুখে বাংলা
উচ্চারণ নিয়েও তাঁর দুঃখবোধ রয়েছে যা তিনি লিখেছেনও-‘বাংলায় বানান ভুল
আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। এতটাই যে এ বিষয়ে রাষ্ট্র থেকে আরম্ভ করে শিক্ষাভিমানী
বুদ্ধিজীবী কিংবা চতুর দেশভ্রমণকারী ব্যক্তিত্বশালী লোক পর্যন্ত কুণ্ঠাবোধ করেন
না।’
বাংলা বানানই হোক উচ্চারণই হোক-এ
ভাষার প্রতি অসম্মান, অবজ্ঞায় তিনি শিশুর মত কষ্ট পেতেন। যন্ত্রণা হত তাঁর। কত ক্লাসে
বলেছেন তিনি-
‘তোমাদের চেহারাটাকে সাজানোর জন্য
তোমরা যতটা সময় ব্যয় করেছ তার কিছুমাত্র কি মুখের কথাটির জন্য ব্যয় করেছ?’ কিন্তু যা দিয়ে
আরম্ভ করেছিলাম তাই বলছি যে,
এই কঠিন রুগ্নপ্রায় বিরক্তিকর একটা
বিষয়কে তিনি প্রাণ দিয়েছেন-বাংলাদেশের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন। কণ্ঠশীলনের
উচ্চারণের ক্লাসটির জন্য শুক্রবারে তিনি কোথাও ক্লাস নিতেন না, কোথাও যেতেন না।
তাঁর কাছে থেকে শিখেছি শুক্রবার মানে কণ্ঠশীলন, কণ্ঠশীলনের বাচিক উৎকর্ষ। আমরা এই
বিশ্বাসকে আদর্শ করতে চাই আজীবন।
( গোলাম সারোয়ার, সহ-সভাপতি, কণ্ঠশীলন, উচ্চারণ বিষয়ক প্রশিক্ষক )
No comments:
Post a Comment