মানচিত্রে টেকটনিক প্লেট


এটি পৃথিবীর মানচিত্র। পৃথিবী যদিও একটি গোলক তারপরও এর উপরিভাগের মানচিত্র এভাবে সমতল হিসেবে ব্যবহার করা সুবিধাজনক। ছবিতে মোটা কালো রেখা দিয়ে যেই সীমানাগুলো পৃথক করা হয়েছে সেগুলো টেকটনিক প্লেটএর সীমা। পৃথিবীর উপরে একটি কঠিন পাতলা ত্বক আছে (crust) ৩০ থেকে ৫০ কিলোমিটার পুরু। এর নিচে মোটা উত্তপ্ত ও গলিত স্তরটি ম্যান্টেল। উপরের পাতলা ত্বকটি নিরবচ্ছিন্ন নয় বরং বিভিন্ন খন্ডে ভাগ হয়ে টেকটনিক প্লেটগুলো তৈরি করেছে। এই প্লেটগুলো নিচের গলিত ম্যান্টেলের উপর অনেকটা ভাসমান ধরা যায়। এবং এগুলো খুবই ধীরে ধীরে ভেসে ভেসে কোটি কোটি বছর ধরে একস্থান থেকে আরেক স্থানে চলেও যায়। এবং এর ফলে এরা প্রায়ই একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় (তীর চিহ্ন দিয়ে প্লেটগুলোর গতির দিক দেখানো হয়েছে)। অনেক সময় সংঘর্ষের স্থান উঁচু হয়ে পর্বত তৈরি হয়, অনেক সময় একে অপরের নিচে ঢুকে যায়। তবে যেহেতু এটি খুব ধীর প্রক্রিয়া তাই আমরা স্বাভাবিকভাবে তা বুঝতে পারি না। আমরা বুঝি যখন সংঘর্ষে দীর্ঘদিনের কোনো গতিময়তার কারণে হঠাৎ করে ঝাঁকুনি ইত্যাদি তৈরি হয় তখন। অনেক সময় পাহাড়ের উপর বড়বড় পাথর সুদীর্ঘ সময় স্থিতিশীল থাকার পরেও ভুমিক্ষয় ইত্যাদির ফলে যেমন হঠাৎ একদিন ধ্বস নামে বিষয়টি তেমনই। এই টেকটোনিক প্লেটগুলো কোনো কারণে কেঁপে গেলে সেটি ভুমিকম্প হিসেবে অনুভুত হয়। যেহেতু প্লেটগুলো বিশাল বিশাল এবং সংঘর্ষগুলো হয় প্লেটের কিনারা বরাবর তাই পৃথিবীর সবএলাকা ভুমিকম্পপ্রবণ নয় বরং এর প্লেটের কিনারা বরাবর এলাকাগুলোই বেশী ভুমিকম্প প্রবণ। বাংলাদেশের অবস্থান লক্ষ্য করলে দেখবেন এর উপরের দিকে দুটি প্লেটের একটি সংযোগস্থল পার হয়ে গেছে। মূলতঃ এই সংযোগস্থলের নিচের প্লেটটি উপরের প্লেটটিকে ধাক্কা দিতে দিতেই হিমালয় পর্বতমালা তৈরি করেছে। এই এলাকাটি তাই ভুমিকম্পপ্রবণ এলাকা হিসেবে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। তাই এই এলাকায় মাঝেমাঝে ছোট বড় মাঝারি ইত্যাদি কম্পন অনুভুত হবে। তবে বাংলাদেশ অধিকাংশ অঞ্চল পুরোপুরি প্লেটের সংযোগস্থলে পড়েনি বলে খুব বড় ধরনের ঝাঁকুনির সম্ভবনা এখানে কিছুটা কম, তবে মাঝারী মানের কম্পনও বাংলাদেশে বড় ধরনের ক্ষয়-ক্ষতি সৃষ্টি করার জন্য যথেষ্ঠ। নেপাল, ভারত ও পাকিস্তানের বিরাট অংশ এই প্লেটের সংযোগস্থলের সরাসরি উপরে অবস্থান করছে।
এটাই ভুমিকম্পের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। ভুমিকম্প প্রতিরোধ ও প্রতিকার করতে হলে এই ব্যাখ্যা মেনেই তা করতে হবে। এবং এই ব্যাখ্যা আমলে নিয়েই ভুমিকম্প হতে সবচেয়ে বেশী নিরাপত্তা তৈরি করা যাবে। কেউ যদি ভুমিকম্পের অন্য কোনো ধরনের উদ্ভট, বানোয়াট, অজগুবি ও অবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হাজির করার চেষ্টা করে তাহলে সেটি ভুমিকম্প হতে নিরপত্তার জন্য হুমকী সৃষ্টি করতে পারে এবং তাই জনগোষ্ঠীর ভয়াবহধরনের ক্ষতিও করতে পারে। এইজাতীয় অপব্যাখ্যা দানকারী ব্যাক্তিবর্গকে তাই শাস্তিরও আওতায় আনাও বিবেচ্য হতে পারে।

ভূতত্ত্ব ও নগরায়ন


সুচনাঃ বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর ঘনবসতি পূর্ণ উন্নয়নশীল দেশ। এদেশের প্রায় ২৮ (আঠাশ) ভাগ মানুষ বাস করে শহরে আর বাকি ৭২ (বাহাত্তর) ভাগ মানুষের আবাস গ্রামে। গ্রামীন উপনিবেশের পাশাপাশি বিভিন্ন শহরাঞ্চলেও অপরিকল্পিত ছড়ানো ছিটানো এলোমেলো ভাবে বসতি গড়ে উঠতে দেখা যায়। দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে একদিকে যেমন বাড়ছে ঘরবাড়ির সংখ্যা তেমনি অন্যদিকে কমছে কৃষিজমি। দেশের সার্বিক উন্নয়নে, কৃষি জমির উপর চাপ কমাতে স্বল্প জায়গায় অধিক মানুষের বাসস্থানের চাহিদা মেটাতে প্রয়োজন সঠিক ও সুচিন্তিত নগরায়ন।
এদেশের বিচিত্র আর্থসামাজিক অবস্থা, প্রতিকুল ভৌগলিক অবস্থান ও ভূ-তাত্ত্বিক গঠন নগরায়নে বাধা সৃষ্টি করে। নদী মাতৃক এ দেশে প্রচুর উপনদী ও শাখানদী বহমান যার ফলে নগর উন্নয়নের পাশাপশি সড়ক ও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হয়। ড্রেনেজ ব্যবস্থা এবং উচ্চ ও নিম্ন ভূমি নিয়ন্ত্রণকারী ভূ-গাঠনিক প্রক্রিয়াসমূহ মনুষ্য উপনিবেশ এবং নগরায়নে প্রভাব ফেলে। ভূমিরূপের দিক থেকে বাংলাদেশের অধিকাংশই নিম্ন ভূমি। যার ফলে প্রতিবছর স্বাভাবিক বর্ষায়ও এর এক-চতুর্থাংশ ভুমি পানিতে নিমজ্জিত থাকে। এদেশের বেশিরভাগ জায়গা প্রতিবছর বন্যা ও খড়ায় আক্রান্ত হয়। বন্যাপ্রবণ এলাকাগুলোতে সাধারণত মাটি ভারাট করে উচু ঢিপি তৈরী করে তার উপর ঘর-বাড়ি নির্মাণ করা হয়। সমূদ্র তীরবর্তি এলাকাগুলো নিম্নাঞ্চল হিসেবে পরিচিত। এসব এলাকায় বাঁধ তৈরী করে এলাকাগুলোকে সামূদ্রিক ঢেউ বা সামূদ্রিক ঝড় থেকে রক্ষা করা হয়। কখনও কখনও সাইক্লোন বা সামূদ্রিক ঝড়ের কারণে এ বাঁধ গুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যার ফলে এসব এলাকার নগরায়ন অবোকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
চট্রোগাম ও চট্রোগ্রাম পর্বতমালা এবং সিলেটের কিছু অংশ ছাড়া বাংলাদেশের প্রায় পুরো অংশই অদৃঢ় নদীজ এবং সামূদ্রিক পলল দ্বারা আবৃত। ফলে গুনগতমানের নির্মাণ উপাদান যেমন বড় দানাদার বালু এবং গ্রাভেল স্বল্পপরিমানে পাওয়া যায়। শুধুমাত্র কাদামাটি যা ইট তৈরীতে ব্যবহৃত হয় তা পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায়।
এযাবতকালে প্রশাশনিক কেন্দ্রসমূহ যেমন উপজেলা, জেলা এবং বিভাগীয় এলাকাগুলো নগর ও শহরে পরিনত হয়েছে। এই এলাকাগুলো বড় রাস্তা এবং রেল লাইন দ্বারা সংযুক্ত হয়েছে। এসব রাস্তা ও রেল লাইনের পার্শ্ববর্তি এলাকাগুলো সহজেই বিদ্যুৎ, টেলিফোন ও গ্যাসের সুবিধা প্রাদান করা হয়েছে। ভূ-বিজ্ঞানের দিকগুলি বিবেচনা করে রাস্তা ও রেল লাইন এবং নদীর বা বাঁধের পাশদিয়ে নগরায়নের পরামর্শ গ্রহণ করা যেতে পারে।
পরিচিতিঃ বাংলাদেশ একটি ছোট দেশ যার আয়তন ১,৪৭,৫৭০ বর্গকিলোমিটার। এদেশের জনসংখ্যা প্রায় ষোল (১৬) কোটি ( প্রায় ১৬০ মিলিয়ন)। এদেশের অর্থনীতি এখন অবধি কৃষিনির্ভর। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০১৩ খৃঃ তে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১.২২ শতাংশ এবং শতকরা প্রায় বাহাত্তর (৭২) ভাগ মানুষ গ্রামে বাস করে এবং বাকি অংশ বাস করে শহরে। দিনে দিনে মানুষ বাড়ছে। বাড়ছে মানুষের আবাস স্থল সহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় চাহিদা। ফলশ্রুতিতে কৃষি জমির উপর গড়ে উঠছে ঘরবাড়ি কলকারখানা ইত্যাদি। কমে যাচ্ছে কৃষিজমি। এদেশের ভৌগলিক অবস্থান ও ভূতাত্ত্বিক গঠনের কারণে নিয়মানুগ নগরায়ন ও যোগাযোগ ব্যাবস্থার উন্নয়ন ব্যহত হয়। বাংলাদেশের ভূ-তাত্ত্বিক অবস্থা ও এর সাথে সম্পৃক্ত প্রাকৃতিক দূর্যোগসমূহ স্বল্প জায়গায় টেকসই ও দ্রুত নগরায়নে বাধা সৃষ্টি করে। ভৌগলিক অবস্থান, ভূ-তাত্ত্বিক গঠন ও বিচিত্র আর্থসামাজিক অবস্থার কারনে দ্রুত নগরায়নে বিভিন্ন সমস্যা দেখা যায়।
ভৌগলিক অবস্থানঃ গনপ্রাতন্ত্রী বাংলাদেশ উত্তর অক্ষাংশ ২৩˚৩৫′ থেকে ২৬˚৭৫′ এবং পশ্চিম দ্রাঘিমাংশ ৮৮˚০৩′ থেকে ৯২˚৭৫′ পর্যন্ত বিস্তৃত। ভারত মহাসাগরের অন্তর্গত বঙ্গোপসাগরের টুপি হিসেবে বাংলাদেশ অবস্থান করছে যার প্রভাব এদেশের মাটি ও মানুষের উপর পরিলক্ষিত হয়।
ভূ-অবোকাঠামো ও ভূমি রূপঃ ভূমিরূপ ও বৈশিষ্টের উপর ভিত্তিকরে বাংলাদেশকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে যথা- তিস্তা ফ্যান, মধুপুর ও বরেন্দ্র ভূমি, ব্রহ্মপূত্র প্লাবনভূমি, আত্রাই প্লাবনভূমি, সিলেট ডিপ্রেশন (ট্রাফ), সিলেট পর্বতমালা ও চট্রোগ্রামের চট্রোগাম পর্বতমালা। এসব পর্বতের উচ্চতা সমূদ্র পৃষ্ঠ হতে ২০ মিটার থেকে শুরু এবং সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ কেওকাড়াডাং-এর উচ্চতা সমূদ্র পৃষ্ঠ হতে ৮৮৩.৯২ মিটার। মধুপুর ও বরেন্দ্র ভূমির উচ্চতা সমূদ্র পৃষ্ঠ হতে ৬ থেকে ৮৫ মিটার। সমূদ্র তীরবর্তি এলাকা, ডেল্টা এলাকা এবং ডিপ্রেশনের উচ্চতা সমূদ্র পৃষ্ঠ হতে ০ থেকে ৩ মিটার। নগরায়নের উপর ভূমির অবকাঠামো বা ভূমিরূপ এবং এর উচ্চতার যথেষ্ট প্রভাব থাকে। বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চল সমূহে সমূদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রতিকুল প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এছাড়া নদীজ ক্ষয় (রিভার ইরোশন) এদেশের নগরায়নে দারুন সমস্যার সৃষ্টি করে।
জলবায়ু ও পানিতত্ত্ব (হাইড্রোলজী)ঃ আমাদের এই বাংলাদেশে গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ু বিদ্যমান যেখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। এদেশে বৃষ্টিপাতের পরিমান ১৫৩০ মিলিমিটার থেকে ৫১০ মিলিমিটার। এখানে প্রায়শ্চই ধ্বংসাত্বক সাইক্লোনিক ঝড় হয়। গত ১৭৯৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১০০ টিরও বেশি প্রলয়ংকারী ঝড় এদেশকে আক্রমন করেছে। এসব প্রাকৃতিক দূর্যোগও নগরায়নে বিশেষ সমস্যা সাধন করে। নদী মাত্রিক এদেশে প্রায় ৩১০ টি উল্লেখযোগ্য নদী রয়েছে যা গড়ে তুলেছে গঙ্গা, ব্রহ্মপূত্র ও মেঘনা নদীর বৃহৎ নদীব্যবস্থা (রিভার সিস্টেম)। এসকল নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ২২,১৫৫.০০ কিলোমিটার। মোট ক্যাচমেন্ট এলাকা (বৃষ্টিপাতের দরূণ যে অঞ্চল হতে নদীতে জল সরবরাহ হয়) প্রায় ১.৫ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার। এইসমস্ত নদীতে বাৎসরিক পানির প্রবাহ প্রায় ১,১০০.০০ মিলিয়ন একর ফুট পানি এবং প্রতি বছর প্রায় ২.৪ বিলিয়ন টন পলল বহন করে। প্রতি বছর প্রায় ২৬,০০০ বর্গকিলোমিটার নিম্ন ভূমি এলাকা প্লাবিত হয়। প্রতি বছর বন্যার কারনে প্লাবনভূমি এলাকায় নগর অবকাঠামের ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ভূ-গঠনাত্মক (জিও-টেকটনিক) সেটআপ ও ভূ-তাত্ত্বিক গঠনঃ ভূ-গঠনাত্মক ঘটনার উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশকে আটটি অঞ্চলে ভাগ করা হয় যথা- ১) হিমালয়ান ফরডিপ ২) রংপুর প্লাটফর্ম ৩) বগুড়া শেল্ফ ৪) হিঞ্জজোন ৫) ফরিদপুর-সিলেট ট্রাফ ৬) বরিশাল গ্রাভিটি হাই ৭) হাতিয়া ট্রাফ এবং ৮) ত্রিপুরা- চট্রোগ্রাম ফোল্ড বেল্ট। কোন অঞ্চলের ভূ-গঠনাত্মক (জিও-টেকটনিক) সেটআপ উক্ত অঞ্চলের ভূমিবৃত্তি ও উচ্চতা নিয়ন্ত্রণ করে। টেকটনিক জোনের বৈশিষ্টের কারনে কিছুকিছু এলাকা নগরায়নের জন্য উপযোগী হয় আর কিছুকিছু এলাকা হয়না। ভূ-তাত্ত্বিক কাঠামো যেমন- উপ-পৃষ্ঠ ধনুকাকার গঠন (সাবসারফেস এন্টিক্লাইন), প্রস্তরময় ভিত্তিভূমি (সিনক্লাইন), চ্যুতি (ফল্ট) ইত্যাদি নগরায়ন প্রক্রিয়ার উপর বিস্তর প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশে প্রচুর ছোট-বড় চ্যুতি বিদ্যমান। ভূ-তাত্ত্বিক গঠনের কারণে পদ্মা-গঙ্গা নদীর উত্তর-পূর্ব এলাকাগুলি ভূমিকম্প প্রবণ। অতীতে অনেক ভূমিকম্প প্রবণ এলাকার নগর-বন্দর ধ্বংসলীলায় পরিণত হয়েছে। সুতরাং ভূমিকম্প প্রবণ এলাকার নগরায়নকে বিশেষভাবে বিবেচনা করা উচিত।
ভূ-তত্ত্বঃ সিলেট পর্বতমালা ও ত্রিপুরা- চট্রোগ্রাম ফোল্ড বেল্ট এলাকা সমূহ বালু (স্যান্ডস্টোন), পলিশিলা (সিল্টস্টোন), কর্দমশিলা (শেল) এবং কাদা (ক্লে) ইত্যাদি নবজীবীয় শিলা দ্বারা গঠিত। শীলাসমূহের বৈশিষ্টের কারণে এখানে খাড়া ঢাল বিদ্যমান। তাই মাটি লতানো (সয়েল ক্রীপিং) ও ভূমিধ্বসের মত ঘটনা এখানে নিয়মিত ঘটে থাকে। বাংলাদেশের প্রায় ৮৫% ভাগ এলাকা মধুপুর ও বরেন্দ্র ভূমির কাদা (মধুপুর এন্ড বারিন্ড ক্লে রেসিডিয়াম), পলিজ অবক্ষেপন বা পলিজ তলানি (এলুভিয়ার ডিপোজিট), বদ্বীপিয় অবক্ষেপন (ডেল্টিক ডিপোজিট), বিলজাত অবক্ষেপন (পেলুডিয়াল ডিপোজিট) এবং উপকূলবর্তী অবক্ষেপন (কোস্টাল ডিপোজিট) দ্বারা আবৃত যা বালু (স্যান্ড), পলিশিলা (সিল্ট) এবং কাদা (ক্লে) দ্বারা গাঠিত। অবক্ষেপনের বৈশিষ্টের উপর ভিত্তি করে কিছুকিছু শিলাস্তরের একক নগরায়নের জন্য ভাল। এদেশে কাদামাটির অবক্ষেপন অনেক পরিমানে দেখা যায় যা ইট তৈরীতে ব্যবহৃত হয়। আবার মধ্যম দানাদার বালু (মিডিয়াম গ্রেইন্ড স্যান্ড) কন্সট্রাকশনে ব্যবহৃত হয়।
নগরায়নের ইতিহাস, আর্থসামাজিক আবস্থা এবং ভূতাত্ত্বিক মানচিত্রায়নঃ বাংলাদেশে ঠিক কখন থেকে নগরায়নের সূত্রপাত ঘটে তা ভালভাবে জানা যায়না। পি-টলেমির প্রাচীন বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে জানা যায় যে, এদেশে প্রাচিন কালেও নগর এলাকা ছিল। কুমিল্লা জেলার ময়নামতির ধ্বংসাবশেষ, বগুড়ার মহাস্তনগড় এবং জয়পুরহাটের পাহাড়পুর প্রাচীন বাংলার নগর উপনিবেশ ও বৃহৎ পুরকৌশল কাজের নিদর্শন বহন করে। মোঘল, পাঠান ও ব্রিটিশ আমলে এখানে নগর উপনিবেশ ছিল। যেহেতু এখানকার অর্থনীতি ছিল কৃষিনির্ভর তাই অতীতে এখানে বৃহৎ মাত্রায় নগরায়ন গড়ে উঠেনি। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রশাসনিক কেন্দ্র যেমন-ইউনিয়ন, উপজেলা (থানা), জেলা, বিভাগীয় কেন্দ্রস্থান সমুহ এবং রাজধানী গড়ে উঠেছে। সম্প্রতি নগরায়ন উন্নয়ন ইউনিয়ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৪৯০ টি থানা, ৪৪৮৬ টি ইউনিয়ন রয়েছে। যেহেতু বাংলাদেশে কৃষি ভিত্তিক রাজনীতি বিরাজমান, তাই বেশির ভাগ মানুষ কৃষিজমির কাছাকাছি বসবাস করে। এবং পল্লী অঞ্চলে যত্রতত্র গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিত উপনিবেশ।
বাংলাদেশে নগরায়নের কিছু প্রস্তাবনাঃ
বাংলাদেশের ভূ-তাত্ত্বিক অবস্থা ও এর সাথে সম্পৃক্ত প্রাকৃতিক দূর্যোগসমূহ স্বল্প জায়গায় টেকসই ও দ্রুত নগরায়নে বাধা সৃষ্টি করে। ভৌগলিক অবস্থান, ভূ-তাত্ত্বিক গঠন ও বিচিত্র আর্থসামাজিক অবস্থার কারনে দ্রুত নগরায়নে বিভিন্ন সমস্যা দেখা যায়। বর্তমান সময়ের বহুল আলোচিত জানযট সমস্যা জনজীবনকে করে তুলেছে দুঃর্বিসহ। রৈখিক নগরায়ন বা বৃত্তাকার কয়েল বা মাকড়শার জাল আকৃতির নগরায়ন হতে পারে এসব সমস্যা মুক্ত নগরায়ন।
রৈখিক নগরায়নঃ
প্রাচীন কাল থেকেই এর প্রচলন দেখা যায়, তখন নগর গড়ে উঠতো নদীর পাশে। যেহেতু সে সময়ে নৌকা ছিল অন্যতম বাহন তাই নদীর তীর ঘেঁসে গড়ে উঠেছিল রৈখিক নগরায়ন। সময় বদলেছে, বেড়েছে স্থল পথের ব্যবাহার। এই রাস্তার পাশদিয়ে গড়ে উঠতে পারে রৈখিক নগরায়ন। ঢাকার বাহিরের নদীতীর ধরে যদি হাইওয়ে নির্মিত হয় তবে তার পাশদিয়েও গড়ে উঠতে পারে নগরায়ন।
বৃত্তাকার কয়েল বা মাকড়শার জাল আকৃতির নগরায়নঃ
ব্যস্ততম নগর ঢাকার জন্য এই পদ্ধতি হতে পারে যুগোপযোগী। নগরায়ন হবে বৃত্তাকার কয়েল আকৃতির। এবং রাস্তাসমূহ হবে কয়েল আকৃতির। যেখানে কোন চৌরাস্তা বা পাঁচরাস্তার মোড় থাকবে না। কোন এক কেন্দ্র বিন্দু থেকে নগর শুরু হবে বিস্তৃত হবে কয়েল আকৃতিতে। কেন্দ্র বিন্দুটি এমন থাকবে যে সেখানে থাকবে কিছুটা ফাঁকা জায়গা যেটা হতে পারে একটি স্টেডিয়াম। আর সবচেয়ে দুরবর্তি স্থান থেকে কেন্দ্রবিন্দু পর্যন্ত চার/ পাঁচটি রেডিয়্যাল ফ্লাইওভার যা বার্ডস আই ভিউতে দেখাবে মাকড়শার জালের মত।
নগরায়ন একটি জটিল পদ্ধতি। নগরায়নের ফলে উক্ত এলাকার ভূমিরূপ, নিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং সেখানকার জনমানুষের জীবন ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে। প্রচুর অর্থ, সম্পদ ও মানুষ একটি নগরায়নের সাথে জড়িত। সুতরাং টেকসই নগর উন্নয়ণের লক্ষ্যে বহুমূখী অভিগমন ও সুচিন্তিত যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

কাঁচতত্ত্ব


ভূত্বক গঠনকারী উপাদান গুলোর মধ্যে অন্যতম উপাদানগুলি হচ্ছে অক্সিজেন (৪৬.৬%), সিলিকোন (২৭.৭%), অ্যালুমিনিয়াম (৮.১%), লোহা (৫%), ক্যালসিয়াম (৩.৬%), পটাসিয়াম (২.৮%), সোডিয়াম (২.৬%), ম্যাগনেসিয়াম (২.১%) ইত্যাদি। এই উপাদানগুলি খনিজ আকারে ভূত্বকে বিদ্যমান। ধাতব সিলিকোন অক্সিজেনের সাথে যুক্ত হয়ে একটি গ্রুপ তৈরী করে এর নাম সিলিকেট গ্রুপ এবং এই গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত খনিজ বা মিনারেল সমূহকে বলা হয় সিলিকেট মিনারেল। ভূত্বকের শতকরা প্রায় ৯০ ভাগেরও বেশি অংশই সিলিকেট মিনারেল বা সিলিকেট খনিজ দ্বারা গঠিত। সর্বাধিক প্রাচুর্যতা সম্পন্ন সিলিকেট মিনারেল হচ্ছে ফেল্ডস্পার মিনারেল (পটাসিয়াম/সোডিয়াম,ক্যালসিয়াম অ্যালুমিনিয়াম সিলিকেট) তন্মধ্যে প্লাজিওক্লেস ফেল্ডস্পার (সোডিয়াম,ক্যালসিয়াম অ্যালুমিনিয়াম সিলিকেট) ৩৯% এবং অ্যালকালি ফেল্ডস্পার (পটাসিয়াম অ্যালুমিনিয়াম সিলিকেট) ১২%। অন্যান্য সিলিকেট মিনারেল গুলোর মধ্যে স্ফটিক বা কোয়ার্টজ ১২%, পাইরোক্সিন ১১%, এমফিবল ৫% এবং ক্লে মিনারেল ৫%। এছাড়া সিলিকেট গ্রুপের অন্যান্য খনিজ সমূহ ভূত্বকের মাত্র ৩ ভাগ এবং ভূত্বকের মাত্র ৮ ভাগ ননসিলিকেট মিনারেল অর্থাৎ কার্বনেট, অক্সাইড, সালফাইড ইত্যাদি।

প্রকৃতির খেয়ালে কিছু প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া যেমন বাতাস, পানির স্রোত, তাপ, চাপ ইত্যাদির কারণে ভূত্বকের কিছু অংশ ক্ষয়ে যায় এবং স্থানচ্যুত হয় এবং অজনা উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। ভূত্বকের একক হচ্ছে শীলা। প্রত্যেক শীলায় থাকে খনিজ। প্রত্যেক খনিজের থাকে স্বাধীন হওয়ার প্রচন্ড সহজাত প্রবৃত্তি। সেই কারণে ভূত্বকের প্রত্যেক একক প্রত্যেক এককের সাথে সংঘর্ষ করে এবং প্রতিনিয়ত করতেই থাকে। ফলে এদের আকার ছোট হতে হতে ব্যাস দুই (২) মিলিমিটারের চেয়ে কম হলে বালিকণা বা স্যান্ড গ্রেইনে পরিনত হয়। সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে এরা অবক্ষেপ বা স্যান্ড ডিপোজিট হিসেবে জমা হয়। এই অবক্ষেপের বেশির ভাগই কোয়ার্টজ বা স্ফটিক কণা। সিলিকা সম্মৃদ্ধ বালি থেকে বর্তমানে তৈরী হচ্ছে উৎকৃষ্ট কাচ। কাচের সাথে জড়িয়ে আছে ধর্ম, ইতিহাস, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। মনুষ্য সভ্যতায় কাচের অবদান অনেক এবং যুগে যুগে তা বেড়েই চলেছে।
কাঁচ নির্মিত আয়নায় আমরা আমাদের অয়বয়ব দেখতে পছন্দ করি। বাংলায় এমন একটি প্রথা চালু আছে যে, বিবাহ অনুষ্ঠানে বর ও কনে পরস্পরের মুখ দেখাদেখি করে আয়নার ভিতর দিয়ে। এই আয়না একটি নব দম্পতিকে কতই না আপন করে দেয়! আয়না বা কাচ কখন প্রথম তৈরী হয়েছিল বা ব্যবহৃত হয়েছিল তা ভাল ভাবে জানা যায় না তবে সোলেমান (আঃ) এর সময়েও যে কাঁচের ব্যবহার ছিল তা জানা যায়।
মানব জীবনে কাচের ব্যবহার অতি বিস্তর। একসময় কাঁচ শুধুমাত্র ব্যবহৃত হত জানালায় কিন্তু এখন বাসার দেয়াল নির্মিত হচ্ছে কাচ দিয়ে। বর্তমান স্থাপত্যের ধারা এবং প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে ভবনে কাঁচের ব্যবহারে এসেছে অভূতপূর্ব পরিবর্তন। বর্তমানে নবায়ন যোগ্য শক্তির উপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। তাই ভবনে ব্যবহৃত হচ্ছে ফটোভোল্টিক কাঁচ।
কাঁচ তৈরীর জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল কাঁচবালি প্রকৃতিতে পাওয়া যায়। বাংলাদেশে দুইটি ফ্লট কাঁচ কারখানা আছে। একটি চট্টগ্রামে পিএইচপি গ্লাস ফ্যাক্টরি ও অপরটি টাঙ্গাইলে- নাসির ফ্লট গ্লাস ফ্যাক্টরি। জানা যায় যে পিএইচপি গ্লাস ফ্যাক্টরিতে সর্বনিম্ন ৭১% সিলিকা (SiO২) সমৃদ্ধ বালি বা স্যান্ড ব্যাবহৃত হয়।
তিনটি কারণ কাঁচ বালির গুনাগুন নিয়ন্ত্রণ করে যথা- ১) বালিকণার আকার এমন হতে হবে যাতে ২০ নং সিভ দিয়ে গমন করতে পারে অর্থাৎ এর ব্যাস ০.৮৪১ মিলিমিটারের কম হতে হবে। বাংলাদেশে ব্রহ্মপূত্র-যমুনা ও গঙ্গা নদীর কিছু কিছু অংশে এরকম বালির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় ২) সিলিকার উপস্থিতি হতে হবে প্রাচুর্যপূর্ণ এবং ৩) আয়রন, ক্রোমিয়াম, কোবাল্ট ইত্যাদি অনুপস্থিত থাকবে বা খুব কম পরিমাণে থাকতে হবে।
অধিক প্রাচুর্যতা সম্পন্ন সিলিকা বালি বাংলাদেশে অপ্রতুল। কানাডায় প্রচুর পরিমাণে কাঁচবালি পাওয়া যায় যা ওট্টয়া স্যান্ড নামে পরিচিত। বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কতিপয় গবেষক গবেষণা করে দেখেছেন যে বাংলাদেশের কাচবালি ওট্টয়া স্যান্ড এর চেয়ে ভাল। বাংলাদেশের শেরপুর জেলার বালিজুরীতে, হবিগঞ্জ জেলার তেলিপারা ও শাহজিবাজারে, কুমিল্লা জেলার চৈদ্দগ্রাম উপজেলায় এবং চট্রোগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলায় কাচবালির মজুদ আছে কিন্তু তার পরিমাণ মাত্র কয়েক মিলিয়ন টন। ব্রহ্মপূত্র-যমুনা ও গঙ্গা নদী এলাকার চরের বালি ব্যবহার করে কৃত্রিমভাবে কাচবালির মজুদ বাড়ানো যেতে পারে। ব্রহ্মপূত্র-যমুনা ও গঙ্গা নদীর কিছু কিছু অংশে ০.৮৪১ মিলিমিটারের চেয়ে কম ব্যাসের বালির অবক্ষেপ পাওয়া যায় যাতে সিলিকার পারিমান অপেক্ষাকৃত কম এবং এসব বালিতে আয়রন, ক্রোমিয়াম, কোবাল্ট ইত্যাদির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তাই এই বালি ফ্লট গ্লাস ফ্যাক্টরিতে ব্যবহার করা যায় না। তবে এই বালিকে প্রক্রিয়াজাতকরণ করে অধিক প্রাচুর্যতা সম্পন্ন সিলিকা বালিতে রূপান্তরিত করা যেতে পারে। বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরীপ অধিদপ্তরের প্রকাশণা ‘‘রেকর্ড অব দ্যা জীওলজিক্যাল সার্ভে অব বাংলাদেশ, ভলিউম-৫, পার্ট-৫” থেকে জানা যায় যে, কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপূত্র-যমুনা ধরলার সংযোগ স্থল হতে সিরাজগঞ্জে এর সাথে করতোয়ার সংগম স্থল পর্যন্ত নদী খাতের চর সমূহের অবক্ষেপের বালিতে প্রায় শতকরা ৮৫ থেকে ৯৫ ভাগই সিলিকা বা কোয়ার্টজ (SiO২) ও ফেল্ডস্পার বিদ্যমান। আর মূল্যবান ভারি খনিজের পরিমাণ প্রায় শতকরা ৫ থেকে ১৫ ভাগ যার গড় পরিমাণ ৯.০১ ভাগ। এখানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ জিরকন, গারনেট, ইলমেনাইট এবং কিছু পরিমাণ রুটাইল ও মোনাজাইট বিদ্যমান।
গত ২৩ ডিসেম্বর ২০১৪ ইং তারিখের দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ ব্রহ্মপুত্র নদে মূল্যবান খনিজের বিপুল সম্ভার’ শিরোনাম সম্বলিত এক সংবাদে বলা হয় ইনস্টিটিউট অব মাইনিং, মিনারেলজি এন্ড মেটালার্জি (আইএমএমএম) সম্প্রতি ব্রহ্মপুত্র নদের প্রবেশ মুখ ও সন্নিহিত এলাকায় একটি জরিপ পরিচালনা করেছে। জরিপ ফলাফল থেকে জানা যায়, নদ দিয়ে প্রতি বছর ৭৩৫ থেকে ৮০০ মিলিয়ন টন পলি প্রবাহিত হয়। এর অন্তত এক তৃতীয়াংশ নদীর বুকে এবং এক তৃতীয়াংশ তীরবর্তী এলাকায় জমা হয়। বাকি এক তৃতীয়াংশ প্রবাহিত হয়ে সমুদ্রে হারিয়ে যায়। ব্রহ্মপুত্র থেকে বছরে প্রায় ২৫০ মিলিয়ন টন খনিজসমৃদ্ধ বালু সংগ্রহ করা সম্ভব। আইএমএমএম’র গবেষণালব্ধ ফলাফলে দেখা যায়, ব্রহ্মপুত্র নদের প্রতি টন বালুর অন্তত অর্ধেক পরিমাণই কোয়ার্টজ। অর্থাৎ প্রতিটন বালু থেকে অন্তত ০.৫ টন কোয়ার্টজ সংগ্রহ করা যাবে। বছরে ২৫০ মিলিয়ন টন পলি উত্তোলন করা হলে তা থেকে অন্তত ১২৫ মিলিয়ন টন কোয়ার্টজ সংগ্রহ উপযোগী। এছাড়া প্রতি টন পলি হতে প্রায় ৬০০ গ্রাম ইলমিনাইট, ৪০০ গ্রাম জিরকন, ৪০০ গ্রাম রুটাইল, ২ কেজি ৫০০ গ্রাম গারনেট এবং ১০০ গ্রাম মোনাজাইট সংগ্রহ করা সম্ভব। কোয়ার্টজ কাচশিল্প ছাড়াও সোলার প্যানেলের সিলিকনের চিপ তৈরিসহ এ ধরনের বিভিন্নকাজে ব্যবহার করা হয়। ইলমিনাইট, রুটাইল ও জিরকন ব্যবহার করা হয় পেইন্ট, পেপার ও সিরামিক শিল্প-কারখানায়। ইলমিনাইট ও রুটাইলের ব্যবহার রয়েছে বিমান তৈরিতে ব্যবহূত টাইটেনিয়ামের উৎস হিসেবেও। গারনেট রত্ন পাথর এবং কাঁচ বা লোহার তৈরি সামগ্রী উজ্জ্বল করতে ব্যবহূত হয়। ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক বিভিন্ন পণ্যের কাঁচামাল হিসেবে মোনাজাইট ব্যবহূত হয়।
আয়রন, ক্রোমিয়াম, কোবাল্ট সমৃদ্ধ খনিজ সমূহ সাধারনত চুম্বকীয় মূল্যবান ভারি খনিজ। ভারি খনিজ পৃথকিকরণ (হেভি মিনারেল সিগ্রেগেশন) ও চুম্বকীয় পৃথকিকরণ (ম্যাগনেটিক সেপারেশন) পদ্ধতির মাধ্যমে ভারি খনিজ সমূহ আহরণের পর বালিতে বিদ্যমান থাকে হালকা খনিজ সমূহ (লাইট মিনারেল্স) যার মধ্যে প্রধান মণিক বা খনিজ হিসেবে সিলিকা বা কোয়ার্টজ (SiO২) ও ফেল্ডস্পারই উল্লেখযোগ্য। এক সময় অধিক ভারি খনিজকে (ভেরি হেভি মিনারেলস) মনে করা হত অধিক মূল্যবান খনিজ বা মণিক (ভেরি ভেল্যুয়েবল মিনারেলস)। কিন্তু হালকা খনিজ সমুহও হয়ে উঠেছে অনেক মূল্যবান। আবার ভারি খনিজের ক্ষেত্রে মনে করা হত ‘যত কাল তত ভাল’ এখন এই ধারনা পাল্টে গেছে। কারণ প্লাটিনাম গ্রুপ মেটাল সমূহ কাল হয়না। ফ্রোথ ফ্লোটেশন প্রসেসের মাধ্যমে হালকা খনিজ সমূহ থেকে ফেল্ডস্পার মিনারেল সমূহকে আলাদা করলে যে অবশিষ্ট বালি পাওয়া যাবে তাই অধিক প্রাচুর্যতার সিলিকা সমৃদ্ধ কাচ বালি যা ফ্লট কাচ কারখানায় কাচ শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
ব্রহ্মপুত্র সহ অন্যান্য বেশির ভাগ নদী বর্তমানে বেহাল অবস্থায় আছে। এর কারণ নদীতে পলি জমা হয়ে চর তৈরী হওয়া। এই চর আমাদের জন্য অভিশাপ। চরের কারণে এদেশে প্রতি বছর বন্যা, ভাঙ্গনসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যায় ঘটছে। হারিয়ে যাচ্ছে মাছ, হারিয়ে যাচ্ছে নদীপথ। এজন্য বিশেষজ্ঞগন ড্রেজিং এর পরামর্শ দিচ্ছেন। পরিবেশবাদীগন নদী বাঁচাও আন্দোলন গড়ে তুলছেন। কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপূত্রের এসমস্ত চর এলাকায় মানুষ মানবেতর জীবন জাপন করছে। এখানে না হয় কোন চাষাবাদ, না আছে কোন কলখারখানা। কর্ম অভাবে এসব এলাকা মঙ্গা পীড়িত এলাকায় পরিনত হয়েছে। কিন্তু এক সময় এরকম ছিল না। চিলমারির বন্দর ছিল কর্মমূখর। লোকজন গাড়ি হাঁকিয়ে চিলমারির বন্দরে যেত। চরের অভিশাপে আজ এসব এলাকার মানুষ মঙ্গা পীড়িত। প্রোয়জনীয় ও পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নিলে এই অভিশাপ হয়ে উঠতে পারে আশির্বাদ। নদীজ এই বালির অবক্ষেপ হতে ভারি খনিজ উত্তোলণ শুরু হলে একদিকে যেমন ভারি খনিজের দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানী করে বাংলাদেশ আয় করতে পারে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা, অপরদিকে কাঁচ শিল্প হয়ে উঠতে পারে সয়ং সম্পন্ন ও সমৃদ্ধিশালী। তাই এখন সময় এসেছে সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে ভারি খনিজ উত্তোলন শুরু করার। কাঁচ শিল্পের পথ সুগম করার তথা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার।

খেতে খেতে জিওলজি শিক্ষা

একটি ডিম সিদ্ধ করে নিন। এখন খাওয়ার উদ্দেশে বসে যান আর শিখে নিন জিওলজি। এখন গোটা ডিমটিকে পৃথিবীর সাথে তুলনা করুন। ডিমের খোসাটা হচ্ছে ক্রাস্ট যা শক্ত ধরনের। খোসাতে দেখুন দুটি স্তর আছে। উপরের স্তর আপার ক্রাস্ট আর নিচের স্তর লোয়ার ক্রাস্ট। ডিমের সাদা অংশ যা খোসার নিচে থাকে সেটা হচ্ছে ম্যান্টেল। এই সাদা অংশটি নরম। অর্থাৎ ম্যান্টেলের অংশটি গলিত পদার্থ দিয়ে গঠিত। খুব ভাল করে দেখলে বুঝতে পারবেন ডিমের এই সাদা অংশকেও দুই স্তরে ভাগ করা যায়। এর উপরে স্তর আপার ম্যান্টেল এবং নিচের স্তর লোয়ার ম্যান্টেল। এবার দেখুন ডিমের কুসুমটি সাদা অংশের চেয়ে শক্ত। এই শক্ত অংশ অর্থাৎ কুসুমটিই হচ্ছে কোর। কুসুমের উপরের অংশে একটু গলিত ভাব থাকে। এই স্তরটি আউটার কোর। আর ভিতরের অংশটি শক্ত। এটি ইনার কোর।
এতক্ষণে পৃথিবীর গঠন শিখে ফেলেছেন। কিন্তু ডিমটি নিশ্চই একেবারে মুখে দিয়ে অভদ্রের মত খেয়ে ফেলেননি। নিশ্চই ভদ্রভাবে কেটে কেটে খাবেন। আর কাটতে কাটতে আপনি শিখবেন জিওলজিক্যাল স্ট্রাকচার। ডিমটি পিরিচের উপর এমন ভাবে রাখুন যেন ডিমের দুই মাথা হরিজন্টালি থাকে। এবার ডিমটিকে মাঝ বরাবর ভার্টিক্যালি কাটুন। এখন ডিমের প্রত্যেক টুকরোই এক একটি ফোল্ডেড স্ট্রাকচার। এবার একটি টুকরোকে এমন ভাবে রাখুন যেন এর মাথাটি উপরের দিকে খাকে আর সমান অংশটি নিচের দিকে থাকে। যে স্ট্রাকচার দেখছেন সেটি ডোম। আবার ডিমটিকে হরিজন্টালি কাটলে উপরের অংশ এন্টিক্লাইন আর নিচের অংশ সিনক্লাইন।

ওপার বাংলায় জিওলজি নিয়ে পেশাগত সুযোগসুবিধে


১. পৃথিবী এবং ভূত্বক নিয়ে গবেষণা বা তার উন্নতি বিষয়ক কাজকর্মের সুযোগ আছে, এরকম বিভিন্ন সরকারি বা বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করতে পারেন জিওলজি গ্র্যাজুয়েটরা।
২. জিওলজি নিয়ে পোস্ট গ্র্যাজুয়েটদের কাজের সুযোগ মেলে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার কাজে, এডুকেশন অফিসার, রিসার্চ আ্যসোসিয়েট ইত্যাদি কাজে। তা ছাড়াও, স্বাধীনভাবে গবেষণার কাজও করতে পারেন কোনও জিওলজিস্ট।
৩. প্রাকৃতিক গ্যাস এবং খনিজ তেল উত্‌পাদক সংস্থা
৪. ভূ-অভ্যন্তরীণ জল বিষয়ে গবেষণাসংস্থা
৫. খনি গবেষণা সংস্থা
৬. সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি
৭. পরিবেশ উন্নয়ন বিষয়ক কনসালট্যান্সি এবং সার্ভিস কোম্পানি
৮. বিভিন্ন পরিষেবা প্রতিষ্ঠান
৯. জাতীয় পরিবেশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান
১০. জিওলজিক্যাল সার্ভে
১১. পরিবেশ সুরক্ষাদপ্তর

বাংলাদেশে জিওলজিতে চাকুরির বাজার আলোকপাত করেছি। এবার দেখি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে কী সুযোগ সুবিধে রয়েছে । 

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়

ভারতে যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে (এবং তার অন্তর্গত বিভিন্ন কলেজে) জিওলজি নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন এবং উচ্চশিক্ষার সুযোগ আছে সেরকম কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উল্লেখ করা হল,
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
কলকাতা
ওয়েবসাইট : www.caluniv.ac.in
কোর্স : জিওলজিতে বি এসসি, এম এসসি এবং পিএইচ ডি
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
কলকাতা
ওয়েবসাইট : www.jadavpur.edu
কোর্স : জিওলজিতে বি এসসি, এম এসসি এবং পিএইচ ডি
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি, খড়্গপুর
পশ্চিমবঙ্গ
ওয়েবসাইট : www.iitkgp.ernet.in
কোর্স : জিওলজিক্যাল সায়েন্সে এম এসসি এবং পিএইচ ডি
বধর্মান বিশ্ববিদ্যালয়
বধর্মান
ওয়েবসাইট : www.buruniv.ac.in
কোর্স : জিওলজিতে বি এসসি, এম এসসি এবং পিএইচ ডি
আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি
আলিগড়
ওয়েবসাইট : www.amu.ac.in
কোর্স : জিওলজিতে বি এসসি, এম এসসি এবং পিএইচ ডি
বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি
বারাণসী
ওয়েবসাইট : www.bhu.ac.in
কোর্স : জিওলজিতে বি এসসি, এম এসসি এবং পিএইচ ডি
জওহরলাল নেহ্রু বিশ্ববিদ্যালয়
নয়া দিল্লি
ওয়েবসাইট : www.jnu.ac.in
কোর্স : এনভায়রনমেন্ট বা ইন্টারডিসিপ্লিনারি সায়েন্সে এম এসসি, এম ফিল এবং পিএইচ ডি
উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়
রাজা রামমোহন রায়
ওয়েবসাইট : www.nbu.ac.in
কোর্স : জিওলজিতে বি এসসি, এম এসসি এবং পিএইচ ডি

ভূবিজ্ঞানীদের আশঙ্কাই সত্য হলো


ভারতের মণিপুর রাজ্যে ভূমিকম্পের আঘাতে বিধ্বস্ত একটি বাড়ি ছবিটি গতকাল রাজ্যের রাজধানী ইম্ফল থেকে তোলা ছবি : এএফপি

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল যে একটা অস্থির ভূস্তরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে সে কথা ভূবিজ্ঞানীরা বারবারই বলে আসছেন বিশেষ করে গত বছর নেপালে পরপর দুটো ভূমিকম্পের পর ভূবিজ্ঞানীদের একাংশ জানিয়েই দিয়েছিল যে, এবার পালা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এবং সেটাই সত্যি হলো

ভূবিজ্ঞানীরা বলছেন, মাটির নিচে ইন্ডিয়ান প্লেট এবং ইউরেশিয়ান প্লেট একে অপরের দিকে ক্রমাগত এগিয়ে চলেছে একটা সময় এই দুটি প্লেট একটি অন্যটির ওপর পিছলে গেলে প্রচুর পরিমাণ শক্তি নির্গত হয় এবং তারই ফল ভূমিকম্প
ওই একটি প্লেট আরেকটি প্লেটের নিচে যত শক্তিতে ঢুকে যাবে, ভূমিকম্পের মাত্রাও তত বেশি হবে। কলকাতার প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূবিদ্যা বিভাগের সাবেক প্রধান হরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য জানান, একটি প্লেট আরেকটি প্লেটের ওপর উঠে যাওয়া কিংবা পিছলে নিচে চলে যাওয়াটা একটা স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ব্যাপার। বহু বছর পর পর এমনটা হয়ে থাকে। কিন্তু, যখন বিষয়টা ঘটে তখন ঘন ঘন গোটা অঞ্চলে ভূমিকম্পের আশঙ্কা থাকে। একটা বা দুটো বড় ধরনের ভূমিকম্প মাটির তলায় চলতে থাকা ক্রমবর্ধমান অস্থিরতাকে হঠাৎ করেই বাড়িয়ে দেয়। তার জন্য একটা বড় ভূমিকম্পের পরে গোটা অঞ্চলে পর পর অনেকগুলো ভূমিকম্পের আশঙ্কা থাকে। মণিপুরের ক্ষেত্রে যেমনটা হয়েছে
জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার অবসরপ্রাপ্ত এক ভূবিজ্ঞানীর মন্তব্য, ‘উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ভূস্তর যে অবস্থায় রয়েছে তাতে আমরা . মাত্রার থেকেও বেশি মাত্রার ভূমিকম্পের আশঙ্কা করছি।অর্থাৎ এই অঞ্চলে আরো বড় মাত্রার ভূমিকম্প হতে চলেছে। সেই আশঙ্কার কথা জানিয়ে দিয়েছেন ওই ভূবিজ্ঞানী
বিজ্ঞানীদের একাংশ বলছে, তাদের পরামর্শ উপেক্ষা করে যেভাবে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের শৈলশহরগুলোতে বিধি না মেনে বহুতল ভবন হয়েছে তাতে পরিস্থিতিকে আরো বিপৎসঙ্কুল করে তুলেছে। মেঘালয়ের পাহাড়ে - মাত্রার ভূমিকম্প হলে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হবে তেমনি ইঙ্গিত কিন্তু ভূবিজ্ঞানীরা দিয়ে রেখেছেন। সূত্র : আনন্দবাজার



ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল যে একটা অস্থির ভূস্তরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে সে কথা ভূবিজ্ঞানীরা বারবারই বলে আসছেন। বিশেষ করে গত বছর নেপালে পরপর দুটো ভূমিকম্পের পর ভূবিজ্ঞানীদের একাংশ জানিয়েই দিয়েছিল যে, এবার পালা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের। এবং সেটাই সত্যি হলো! - See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/deshe-deshe/2016/01/05/309775#sthash.blsxad4K.YqoWkSJt.dpuf
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল যে একটা অস্থির ভূস্তরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে সে কথা ভূবিজ্ঞানীরা বারবারই বলে আসছেন। বিশেষ করে গত বছর নেপালে পরপর দুটো ভূমিকম্পের পর ভূবিজ্ঞানীদের একাংশ জানিয়েই দিয়েছিল যে, এবার পালা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের। এবং সেটাই সত্যি হলো! - See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/deshe-deshe/2016/01/05/309775#sthash.blsxad4K.YqoWkSJt.dpuf
রতের মণিপুর রাজ্যে ভূমিকম্পের আঘাতে বিধ্বস্ত একটি বাড়ি। ছবিটি গতকাল রাজ্যের রাজধানী ইম্ফল থেকে তোলা । ছবি : এএফপি - See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/deshe-deshe/2016/01/05/309775#sthash.blsxad4K.YqoWkSJt.dpuf