বাংলাবানান ও শব্দগঠনঃ ভুল শুধু ভুল


ইদানিং আমাদের বানানের ক্ষেত্রে মারাত্মক বিশৃঙ্খলা লক্ষ্যণীয়। আমরা যে যেমন পারছি লিখে যাচ্ছি শুদ্ধবানান ভেবে। আমাদের পত্রিকাগুলোও এক্ষেত্রে হ-য-ব-র-ল অবস্থার সৃষ্টি করে চলেছে বাংলাএকাডেমির প্রমিত বানানের অজুহাতে। একেক পত্রিকার একেক রকম বানানরীতিও গড়ে উঠেছে, যা হাস্যকর। ফলে আমাদের বানানেও ভুল খুব বেশীই (প্রমিত হবে বেশি) হয়ে যাচ্ছে আজকাল।


আমি এখানে পুরনো রীতির কিছুবানানও ব্যবহার করেছি, যা বাংলাএকাডেমির প্রমিত বানানের সাথে সবক্ষেত্রে নাও মিলতে পারে। এটা আমার ভিন্নমতের কারণেই। কারণ আমি বাংলাএকাডেমির প্রমিত বানানের সাথে সবক্ষেত্রে একমত নই। বিশেষ করে বাংলাএকাডেমির (বিশেষ্য পদ হিসেবে বাংলাএকাডেমি বানানে কিন্তু স্পেস হবেনা) বিতর্কিত বানানরীতি-প্রবর্তনের বা সংস্কারের দরুণই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে আমি মনে করি। অনেক বিতর্কই আছে এসব ব্যাপারে। ১৯৯২ সালের আগের বই-পুস্তকের বানানগুলোর সাথে প্রমিত বানানের নজির খুঁজে দেখলেই আমার কথার প্রমাণ পাওয়া যাবে। এই বিতর্ক নতুন না হলেও ১৯৯২ সালে বাংলাএকাডেমি প্রথম ”সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান’‘ প্রণয়ন করার পর একটি বানানরীতিও তৈরী করায় জটিলতা বেড়ে গেছে।

এখানে একটি কথা উল্লেখ্য যে, যারা মনে করে বাংলাএকাডেমির কলমের খোঁচায় যুগযুগ ধরে প্রচলিত এবং বোধগম্য বানানগুলো বদলিয়ে ফেলায় আগের বই-পুস্তক, দলিলে লিপিবদ্ধ বানানগুলো অশুদ্ধ হয়ে গেছে; তাদের সাথে আমি একমত নই। তাহলে রবিঠাকুর, নজরুল, জসিম, মধুসূদনসহ সবলেখকের বই-পুস্তকের বানানগুলোর কী হবে, নাকি তারা ভুল লিখেছেন বলতে হবে? প্রমিতকরণ মানে কিন্তু তা নয়। অনেককেই দেখি, তারা কাউকে আগের কোনো বানান লিখতে দেখলেই খেঁকিয়ে উঠে প্রমিতবানানের নমুনা হাজির করে বেচারাকে অপদস্ত করেই ছাড়ে। এরা রবিঠাকুর বা নজরুল জীবিত থাকলেও কি আগের বানানগুলোর লেখার জন্য তাদেরও নাজেহাল করতেন? কিংবা তাদের আগের বইগুলো এখন ছিঁড়ে-পূড়ে ফেলবেন? একটা বানানরূপ চালু হতে শতবছর লাগতে পারে, আর একাডেমি যেভাবে বানানবদলিয়ে যাচ্ছে, তাতে প্রতিবছর বাচ্চাদের পাঠ্যবই বদলিয়ে তাদের বিপাকে ফেলার মতো দশাই হবে আরকি?

মনে রাখতে হবে–বাংলাশব্দগঠন বা বানানের ক্ষেত্রে সন্ধি, সমাস, উপসর্গ, বচন, পদ ইত্যাদির ভূমিকা অপরিসীম। আমরা বড়ভাইকে অবলীলায় স্পেস দিয়ে বড় ভাই, বিমানবন্দরকে বিমান বন্দর, পাঁচটাকাকে পাঁচ টাকা, বিজয়দিবসকে বিজয় দিবস, ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয় লিখে থাকি, যা ভুল। এসব নামবাচক (নাম বাচক নয়) শব্দ বা বিশেষ্যপদ (বিশেষ্য পদ নয়) একাধিক শব্দসহযোগে গঠিত হয়েছে, যা পৃথক করলে অর্থ ঠিক থাকেনা আর ব্যাকরণের নিয়মও খাটেনা (স্পেস দিয়েও লেখা চলে ''খাটে না'')।

ভাষার ব্যাকরণ তৈরি না হলে ভাষার কাঠামো ভেঙ্গে গিয়ে যাচ্ছেতাই অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে বলেই ব্যাকরণ থাকাও জরুরি। ব্যাকরণ না থাকলে বাংলিশভাষা আজ স্বীকৃতি পেয়ে যেতো এবং বাংলাভাষার অবস্থাও হতো সংস্কৃত, পালি ইত্যাদি অধুনালুপ্ত ভাষার ন্যায়। তবে ভাষা প্রবহমান জলস্রোতের মতোন যাকে বেঁধে রাখা সম্ভব নয়, মুখে মুখে এর পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জন হবেই। যুগের সাথে তালমিলিয়ে যেমন নতুননতুন শব্দতৈরি হয় তেমনই এর ক্রমবিকাশ অবশ্যম্ভাবী। তখন ব্যাকরণ একে নিয়মের আওতায় নিয়ে আসতে বাধ্য হবে। যেমন-কিছুদিন আগেও ধর্ষণকারী ব্যতীত ”ধর্ষক” শবদটি অভিধানে ছিলোনা, যা এখন আমাদের ভাষার নতুনশব্দ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। এ ধরণের আরেকটি নতুন শব্দ হচ্ছে-সহমত, যা ডিকশনারিতে এখনো যুক্ত হয়নি।



বাংলাভাষা একটু কঠিন হলেও এমন স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাষা যে, বিশ্বে দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া ভার। তবে এর বানান আর শব্দগঠনের বেলায় একটু জটিলতা থাকলেও তা থেকে উত্তরণ অসম্ভব নয়। কিন্তু আমরা যারা সাহিত্যচর্চা করি বিশেষত অনলাইনের বাধাহীন ও সম্পাদনাবিহীন জগতে, তারাও সাধারণ ও সাদামাটা বানান যে হারে ভুল লিখি এবং একটা শব্দকে ভেঙ্গে কতো টুকরো যে করি, যা আর প্রকৃত শব্দের বানান থাকেনা এবং অর্থবিকৃতিও ঘটে যায়।
অনলাইনে সেন্সরশিপ না থাকায় তারা যাচ্ছেতাই লিখে যাচ্ছে দেখে আমি একেবারেই হতাশ। লেখকরা পথপ্রদর্শকের মতো, অথচ তারাই যদি বাংলাবানানের বারোটা বাজিয়ে দেয়, ডিকশনারি না দেখে যাচ্ছেতাই লিখে যায়–ইচ্ছেমতো শব্দও বানায়(?) তাহলে যারা পাঠক-ভক্ত তারা কী শিখবে তাদের কাছে? এটা চরম লজ্জাকর বিষয়। আমি অনলাইনে ৯০% লেখকের ভুলবানান শুদ্ধ করে দিতে দিতে এখন ক্লান্ত। অনেকেই আবার যৌক্তিক ভুলটা স্বীকার না করে অযথা তর্কেও জড়িয়ে পড়ে?
তাই যারা বানানভুল লেখেন এবং ডিকশনারিও অনুসরণ করেন না, তাদের অনুরোধ করি আমার বানানসংক্রান্ত এ প্রবন্ধটা মনোযোগসহ পড়ুন এবং এ বয়সেও নতুন করে একটু ব্যাকরণচর্চা ও ডিকশনারি দেখাও শুরু করুন। তবু ভুলবানান লিখে জনগণকে বিভ্রান্ত করার এবং শহীদদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাভাষাকে অপমানের প্রয়োজন নেই।
বাংলাএকাডেমির প্রমিত বানানঃ
তারা ‘ই-কার’ আর ‘ঈ-কারের বারোটা বাজালেও (বিশেষতঃ বিদেশী শব্দে) ”শহীদ” বা ”শহীদদিবস” এবং বাংলাএকাডেমীর ”একাডেমী” বানান ঠিকই বহাল রেখেছে। কেনো তা আমার বোধগম্য নয়। আইনগত বিষয় থাকলে দালিলিকভাবে ''বাংলাএকাডেমী''র দলিল ও সাইনবোর্ডের বানানে ঈ-কার থাকতেই পারে; কিন্তু তাদের গড়া নিয়মভেঙ্গে তাদের অভিধানেই বা তা থাকবে কোন যুক্তিতে? বাংলাএকাডেমির বাংলাঅভিধানের ১৯৯৮ সালের প্রথম পুনর্মুদ্রণেও এ পুরনোরীতির বানানই বহাল রয়েছে। পরবর্তীতে আইনবদল করে ''একাডেমী'' বানানটি অবশ্য বদলিয়ে ফেলাও হয়েছে।
অধিকাংশ দেশীশব্দের বানানে ঢালাও ই-কার ব্যবহারের রীতি চালু করায় যেমন সমস্যা তৈরী তৈরি হচ্ছে; তেমনই অনেক একই শব্দের একাধিক বানানও তৈরী (প্রমিত হবে তৈরি) করা হয়েছে। এখানে আমি তেমন একাধিক বানানের নমুনাস্বরূপ কিছু দেখিয়েও দিয়েছি ব্রাকেটে। একই শব্দের একাধিক বানান আগেও ছিলো এবং এটা যুক্তিসঙ্গতও। যেমন-পাখি/পাখী, বাড়ী/বাড়ি, গাড়ি/গাড়ী ইত্যাদি বানান ছিলো ঈ-কার দিয়ে এবং এখনো অনেকগুলো এমন বানান বহাল থাকলেও কিছু বানানের ক্ষেত্রে একটিমাত্র রূপ নির্ধারণ করায় সমস্যা বেড়েছে। ১৯৯০ সালের আগের ঈকার দিয়ে লেখা সঠিক বানানটি এখন ভুল বলে বিবেচিত হচ্ছে। তাই একটি বানানের একাধিক অন্ততঃ ২টি বানানরূপ থাকা জরুরি বলেই আমি মনে করি। এতে ভুলবানান লেখার ভয় থাকবেনা, যেটাই লিখুক শুদ্ধ হবে। একাধিক বানানরূপওয়ালা শব্দ এবং বিশেষ কিছুশব্দ ব্যতীত সবশব্দের ক্ষেত্রেই এমন দ্বৈতরূপ থাকার দরকার নেই। এ বিষয়ে সামনে আমি বিশদ বলার চেষ্টা করবো।
তৎসম বা সংস্কৃত শব্দের ঈ-কারকেও অনেকেই ‘ই-কার’ দিয়ে লিখে সঠিক বানান ভেবেই আনন্দ পাচ্ছে। যেমন অহরহ দেখছি-অঙ্গীকারকে (অঙ্গিকার), নীরবকে (নিরব) পক্ষীকে (পক্ষি), হস্তীকে (হস্তি) ইত্যাদি বানানে লিখে চলেছে। আবার এফএম রেডিওগুলো বাংলিশ নামের এক বিকৃত বাংলা চালু করেছে, যা ভবিষ্যতে ভাষার বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে বলে আমার আশঙ্কা। যদিও সম্প্রতি উচ্চআদালত কর্তৃক সর্বত্র বাংলালিখনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে বাংলিশবন্ধকরণসহ, দেখা যাক কী হয়?
প্রমিতবানান বনাম ভুলবানান 
মানুষমাত্রেই ভুল করতে পারে–আমিও তার ওপরে নই। যে কারুর ভুলধরিয়ে দেয়া যেমন ভালো তেমনই তা সংশোধন করে নেয়াও উদারতার লক্ষণ। আমার লেখায় ব্যাকরণগত ভুল কিংবা যৌক্তিক ভুল থাকলে আমি মেনে নেবো। আমি এখানে কঠিন ব্যাকরণের আলোচনা নয়, কিছু সাধারণ বানান বা শব্দগঠন নিয়ে লিখবো, যা আমরা ভুলভাবে লিখে থাকি।
উচ্চারণ ও লিখনে ফারাক থাকবেন কেনো?
একসাথেই বা একনিঃশ্বাসে যে নামবাচক শব্দ বা বিশেষ্যপদ আমরা উচ্চারণ করি, তা আবার লেখার সময় একাধিক শব্দে লিখি কেনো, এটাও বিরাট ভুল। যেমন-নাবলা (না বলা নয়) কথা, নাজানা, নাশোনা, নাদেখা, নাশোকর, অকথা, লাজবাব, একসাথে, একমাত্র, একমত ইত্যাদি।
আমার মনে হয়, বানানগঠনে সন্ধি ও সমাস এর প্রভাবই খুববেশি; যেমন- কলেজের ছাত্র এর ”এর” বিভক্তি লোপ পেয়ে হবে কলেজছাত্র (ষষ্ঠি তৎপুরুষ সমাস), তেমনি সমাস এর নিয়মে বড় যে ভাই-হবে বড়ভাই, বিমান নামে যে বন্দরে-হবে বিমানবন্দর।
কিন্তু একে যদি আলাদা আলাদা করে এভাবে লেখেন বিমান বন্দর, তবে তা আর বিমানবন্দর হিসেবে একটি নামবাচক শব্দ থাকেনা। বরং হয়ে যায় আলাদা দুটো নাম বিমান একখানে আর বন্দর আরেকখানে ঠিক যেনো পৃথক দুটো জিনিস। সমাস এর বিধানানুযায়ী প্রধান যে শিক্ষক হবে প্রধানশিক্ষক একশব্দেই, যা ইংরেজী (প্রমিত হবে ইংরেজি) উচ্চারণে আলাদাভাবে হয় ”হেড মাস্টার”। তেমনই বঙ্গোপসাগর গঠিত হয়েছে -বঙ্গ, উপ, সাগর মোট এই তিনশব্দের সন্ধির নিয়মে যা বেশ শ্রুতিমধুর। অনেকেই শুনলে অবাক হবেন-এমন কিছু বাংলাশব্দ এতোই লম্বা যে, বিশ্বাসই হবেনা; যেমন- ভারতমহাসাগর (ভারতের মহাসাগর ), হ-য-ব-র-ল, শাখাপ্রশাখাযুক্ত (শাখা ও প্রশাখায় যুক্ত), জাতিধর্মবর্ণগোত্রনির্বিশেষে (জাতি ও ধর্ম ও বর্ণ ও গোত্রকে নির্বিশেষে), মৃত্যুসংবাদপ্রাপ্তিসাপেক্ষে (মৃত্যুর সংবাদকে প্রাপ্তির সাপেক্ষে) ইত্যাদি।
কিন্তু আমরা লিখতে গিয়ে একাধিক শব্দে গঠিত একটি শব্দকে স্পেস দিয়ে কতো টুকরো যে করে ফেলি। যদিও বাংলাএকাডেমী এক্ষেত্রে এখনো পর্যন্ত নির্লিপ্ত রয়েছে শুধুমাত্র বানানের ই-কার, ঈ-কার, র/ড়/এই জাতীয় সমস্যা ব্যতীত। ফলে আমরা ব্যাকরণ নাজানা জনগণ শব্দগঠনের এ জটিলতায় পড়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলছি। আমরা জন্মের পর ব্যাকরণ পড়ে যেমন বাংলাশিখিনি তেমনই ব্যাকরণ না জেনেও তা কিন্তু রপ্ত করা যায়।
(শাহ আলম বাদশা)

No comments:

Post a Comment